বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা রিভার ট্যুরিজম

আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২২, ০৭:০০

নদীমাতৃক বাংলাদেশ রিভার ট্যুরিজম অর্থাৎ নৌপর্যটনের দারুণ সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রিভার ট্যুরিজম জনপ্রিয় হলেও দেশে সেভাবে সুযোগসুবিধা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোতে এক সময় ছোট নদ কিংবা বড় বড় খাল বা শাখা নদীর অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু ভৌগোলিক কারণেই হোক অথবা বাড়তি জনসংখ্যার চাপে সেই সব নদনদী খালের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন নদীবিধৌত ভূখণ্ড নেই। এখনো আমাদের বাংলাদেশে যে পরিমাণ নদনদী, খালবিল, ঝিল, হাওর-বাঁওড়, হ্রদ, পুকুর, দীঘি ইত্যাদি রয়েছে সেটাও কম নয়। যার কারণে এদেশে রিভার ট্যুরিজম বা নৌপর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। রিভার ট্যুরিজম আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভিন্নমাত্রা এনে দিতে পারে। এর মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নদী, হাওর, বিল, ঝিল এবং হ্রদকেন্দ্রিক পর্যটন স্পটগুলো। কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, বাগেরহাট বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালীতে নৌপর্যটন শিল্প গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ এবং সম্ভাবনা রয়েছে। রিভার ট্যুরিজমের একটি বিরাট সুবিধা হলো—এখানে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাদ গ্রহণের চমৎকার সুযোগ রয়েছে। যা অন্যান্য পর্যটন উদ্যোগগুলোতে পাওয়া যায় না। আজকাল যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ আমাদের চারপাশের পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে, সে ক্ষেত্রে নৌপর্যটন পর্যটকদের জন্য প্রাশান্তির ছোঁয়া দিতে পারে। এর মাধ্যমে পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব সহকর্মীদের সঙ্গে   কয়েক দিনের জন্য নির্মল প্রকৃতির আস্বাদ গ্রহণের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হবে।

রিভার ট্যুরিজমের জন্য প্রয়োজন ছোট, বড়, মাঝারি আকারের নৌযানের সংখ্যাবৃদ্ধি। আরামদায়ক আধুনিক সুযোগ সুবিধাসংবলিত জাহাজ বা স্টিমারে চড়ে পর্যটকরা সুন্দরবন, ভোলা, হাতিয়া, কাপ্তাই রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, ভৈরব, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনার বিভিন্ন নদীকেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে গেলে সেগুলো বেশ জমজমাট হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। ঐ পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক, ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ডে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হবে এক সময়ে ঢাকার সদরঘাট থেকে নৌপথে চট্টগ্রাম যাতায়াতের সুযোগ ছিল। আশির দশকের শেষ ভাগে তা বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে এই অঞ্চলে রেলপথ ও সড়কপথে ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। এমনিতে নৌপথে যাতায়াত খরচ কম। রিভার ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে এটাও একটি সুবিধাজনক ফ্যাক্টর হতে পারে। এখনও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, হাতিয়া প্রভৃতি গন্তব্যে জাহাজ চলাচলের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা যেতে পারে।

প্রতিবেশী ভারতের কেরালা, জম্মু কাশ্মির কিংবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মারিশাস প্রভৃতি দেশে নৌপর্যটন বেশ খাতি অর্জন করেছে। এসব দেশে রিভার ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা সহজেই চোখে পড়ে। শুধু নদী, হ্রদ, এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাকে কেন্দ্র করে তারা তাদের পর্যটন শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বৈচিত্র্যময় আকর্ষণীয় নৌপর্যটন উদ্যোগগুলো দেশ বিদেশের পর্যটকদের বারবার হাতছানি দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছে, যাতে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ পর্যটক সেসব দেশে বেড়াতে যাচ্ছে প্রতি বছর। কেরালা, জন্মু কাশ্মির কিংবা ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ার মতো আমাদের দেশেও রিভার ট্যুরিজমের চমৎকার আকর্ষণীয় স্পট রয়েছে রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, খুলনা, বাগেরহাট সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। এখন এগুলো অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। অনাদরে অযত্নে অবহেলায় জীর্ণশীর্ণ অনাকর্ষণীয় অবস্থায় পড়ে আছে। সঠিক পরিচর্যা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় নৌপর্যটন ক্ষেত্রগুলোকে সবার আগ্রহ এবং মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা যায়। শুধু কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান কিংবা সুন্দরবন নয়, রিভার ট্যুরিজমের বিকাশের ফলে সমগ্র বাংলাদেশটাই হয়ে উঠতে পারে ভ্রমণের তীর্থস্থান। আমাদের ভাটি অঞ্চলে বড় বড় হাওর, বাওর, বিল, ঝিল, হ্রদগুলো বর্ষকালে সমুদ্রের রূপধারণ করে। মন ভরানো বর্ষার সেই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য জাহাজ, স্টিমার, লঞ্চ, কিংবা স্পিডবোটে চড়ে পর্যটকরা বেরিয়ে পড়তে পারেন।

রাজধানী ঢাকা শহরকে আবেষ্টন করে নৌপথ চালুর বিষয়ে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ওয়াটার বাস চালু করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এখানেও রিভার ট্যুরিজমের বিরাট সুযোগ রয়েছে। ৪০০ বছর আগে ঢাকাকে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন শহরের সঙ্গে তুলনা করা হতো। লন্ডন টেমস নদীর তীরে অবস্থিত আর ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ঐ সময়ে ঢাকা নদীবিধৌত অঞ্চল ছিল। এখন সেই অবস্থা নেই আর। কিন্তু এখনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে রিভার ট্যুরিজমের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং চাঁদপুর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। ১০০ বা ২০০ সিটের ওয়াটার বাস চালু করে তা দিয়ে ঢাকার আশপাশে নৌপথে ঘুরো বেড়ানোর ব্যবস্থা করা হলে মানুষ তা ভীষণভাবে উপভোগ করবে। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। নদীকেন্দ্রিক পর্যটন উদ্যোগগুলোতে আমাদের অনেক নদী ড্রেজিং না করার কারণে ভরাট হয়ে  আছে। যে কারণে ছোট বড় সব ধরনের লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এসব নদী ড্রেজিং করে নাব্য ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য নদীতীরবর্তী শহরের মানুষগুলো রিভার ট্যুরিজমের মাধ্যমে নিজ দেশকে নতুনভাবে আবিষ্কারের সুযোগ নিতে পারে। এ খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নে যুগোপযোগী পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। রিভার ট্যুরিজম বা নৌ পর্যটনের বিকাশের মাধ্যমে আমাদের পর্যটন শিল্প দ্রুত আরো অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারে।

ইত্তেফাক/ইআ