বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিদেশে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু: প্রতিদিন গড়ে ১০ জন কর্মীর লাশ আসছে

আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৫৬

ভাগ্য ফেরাতে বিদেশে কাজ করতে যান বাংলাদেশি কর্মীরা। বেশিরভাগ কর্মীই এজন্য শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেন, নয়তো ঋণ করে যান। কিন্তু প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যেমন ফিরছেন অনেকে, তেমনই কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুও হচ্ছে অনেক কর্মীর। গত বছর রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালে মোট ৩ হাজার ৭৯৩ বাংলাদেশি কর্মীর মরদেহ দেশে আনা হয়েছে। যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের বেশি কর্মীর মরদেহ দেশে এসেছে। বলা হচ্ছে, বেশিরভাগ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে আকস্মিক মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও হৃদরোগে। এই বিপুল সংখ্যক মৃত্যুতে বাংলাদেশি কর্মীদের জীবন, কর্মপরিবেশ নিয়ে উদ্বেগজনক চিত্রই উঠে এসেছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সাল ছিল সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর বছর। ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭ অভিবাসী কর্মীর মরদেহ এসেছিল। ২০১৬ সালে এসেছিল ৩ হাজার ৪৮১ জনের মরদেহ। ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮৩১ জন। আর ২০০৫ সালে সেখানে এসেছিল ১ হাজার ২৪৮ কর্মীর মরদেহ।

ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের উপ-পরিচালক জাহিদ আনোয়ার বলেন, ২০১৮ সালে বৈধ কর্মীদের ৩ হাজার ৬৭৬টি মরদেহ এসেছে। পাশাপাশি অবৈধভাবে কর্মরত ১১৭ কর্মীর মরদেহ এসেছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৫৩ মরদেহ এসেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এছাড়া ৩৭৪টি মরদেহ এসেছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ৬৬টি মরদেহ এসেছে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিদেশে মারা যাওয়া কর্মীর বেশিরভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

বেশিরভাগ মরদেহ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মরদেহ এসেছে সৌদি আরব থেকে। সৌদি আরবের পর বেশি মরদেহ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। গত বছর দেশটি থেকে ৭৮৪ জনের মরদেহ এসেছে।

অভিবাসী কর্মীদের অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও অধিকার কর্মীরা বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে ব্রেন স্ট্রোক ও হৃদরোগে। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। তবে এতো অল্প বয়সে স্ট্রোকে এবং হৃদরোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ অতিরিক্ত মানসিক চাপ। অনেকেই ঋণ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু দেখা যায়, যে টাকা খরচ করে গেছেন তার তুলনায় আয় খুবই কম। এই ঋণ পরিশোধের একটা চাপ সব সময় তাদের থাকে। এছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ, অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা, নিম্নমানের খাবার, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাও এই ধরনের মৃত্যু ত্বরান্বিত করছে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান ইত্তেফাককে বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ জন কর্মীর মরদেহ দেশে আসছে। হিসাব করলে দেখা যাবে, গত ৬ বছরে প্রায় ২০ হাজার কর্মীর মরদেহ দেশে এসেছে। আর এক যুগে এ সংখ্যা ৩৫ হাজারেরও বেশি। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ব্রেন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক। তিনি বলেন, কর্মীদের মরদেহ দেশে আনার পর কখনো ময়না তদন্ত করা হয় না। ফলে প্রকৃত কারণ কখনোই জানা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত মরদেহ দেশের আসার পর ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করা এবং সমস্যা নির্ধারণ করে সমাধানের পথ খোঁজা। একইসঙ্গে তিনি বলেন, অভিবাসন খরচ কর্মীদের মানসিক চাপের অন্যতম কারণ। এই অভিবাসন ব্যয় কমানো গেলে কর্মীরা মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাবেন।

আরো পড়ুন: বিপিএল শেষ স্টিভ স্মিথের

অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশে কর্মীদের কাজের জন্য ভালো পরিবেশ, থাকা-খাওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের রয়েছে। এছাড়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর্মীরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন কিনা সেটাও দেখা জরুরি।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান ইত্তেফাককে বলেন, এ ধরনের মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়। অভিবাসন খরচ কমিয়ে বিদেশে কর্মীদের জন্য ভালো কাজের পরিবেশ তৈরি করা আমাদের এজেন্ডা। আমরা চাই, প্রতিটি কর্মী বিদেশ যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ নেবে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যাবে। এজন্য বিদেশ গমনেচ্ছুদের সচেতন করতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।

ইত্তেফাক/মোস্তাফিজ