শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া ডন মিঠু!

আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:৫৫

টাকার পাহাড় গড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানি-স্টেনোগ্রাফার আবজাল হোসেনের গডফাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। আবজালের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্বাস্থ্যখাতের সর্বত্রই মিঠুর নাম বেরিয়ে আসছে। এই মিঠুকে দুটি মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। একটি ঢাকার শ্যামলীতে, আরেকটি রংপুরে। বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা, লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকা ও অনিয়মের কারণে রংপুরের মেডিক্যাল কলেজটির কার্যক্রম ইতিমধ্যে স্থগিত রাখা হয়েছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরো স্বাস্থ্যখাতে বিস্তৃত মিঠুর জাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর, প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। তারা মিঠুর হয়ে কাজ করে। স্বাস্থ্যখাতে মিঠু মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচরার মহিপুর ইউনিয়নে। মিঠু বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকেন। বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্যখাত। বিদেশেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।

 

দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ন্ত্রণে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটান। কখনো তা অর্থের মাধ্যমে, আবার কখনো হুমকি-ধামকির মাধ্যমে। মিঠুর সিন্ডিকেটের মর্জিমতো কাজ না করে উপায় নেই— বলছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি হাসপাতালের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। কারণ, এই সিন্ডিকেটের লুটপাটসহ নানা রকমের অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে অনেক উচ্চ পর্যায়ের যোগসাজশ রয়েছে। টেন্ডার কারসাজিতে পটু এই সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে সরকারি সিনিয়র পর্যায়ের ডাক্তার, প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাড়াও বাইরের কিছু দালাল ব্যবহার করে। এরা সরকারি যে হাসপাতাল বা যে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সেই হাসপাতালের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আগেই বোঝাপড়া করে নেয়। টেন্ডার যেভাবেই আহ্বান করা হোক না কেন, যে বা যারাই টেন্ডারে অংশ নিক না কেন কাজ তাদেরই দিতে হবে।

 

জানা গেছে, ওই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকলেও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের চাহিদা তৈরি করা হয়। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বরাদ্দ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তারাই এনে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এরপরেই শুরু হয় টেন্ডার কারসাজি। টেন্ডার ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয় টেন্ডার সিডিউল তৈরি করার সময়ই। সিন্ডিকেটের বিশেষ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ যাতে টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে সেভাবেই ‘স্পেসিফিকেশন’ তৈরি করা হয়। সিন্ডিকেটের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কেউ টেন্ডারে অংশ নিলেও সেগুলোকে নানা অজুহাতে ‘নন-রেসপন্সিভ’ করা হয়। এভাবেই কমমূল্যের যন্ত্রপাতি বেশি মূল্যে বা অস্বাভাবিক মূল্যে সরবরাহের কার্যাদেশ আদায় করে নেয় সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, তাতেও এরা ক্ষান্ত হয় না। এক দেশের তৈরিকৃত মালামাল সরবরাহের কথা বলে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আরেক দেশের তৈরি করা কম মূল্যের ও নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করে থাকে। দেখা যায়, ইউরোপ-আমেরিকার মালামালের কথা বলে চীন বা ভারতের মালামাল সরবরাহ করা হয়। যেহেতু সর্বত্রই সিন্ডিকেটের লোকজন নিয়োজিত থাকে তাই এসব জাল-জালিয়াতি কোথাও বাধা পায় না। আর এভাবেই হাতিয়ে নেয়া হয় সরকারের কোটি কোটি টাকা।

 

মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। হাওয়া ভবনের দালাল ছিলেন মিঠু। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে মিঠু সিন্ডিকেট আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর হঠাত্ অস্বাভাবিক উত্থান ঘটে স্বাস্থ্য খাতে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই। অনেক মন্ত্রী-সচিব মিঠুর ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত।

 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ নাসিম। মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রীপদে বসেই যে কোনো ধরনের সিন্ডিকেটকে এড়িয়ে চলার ঘোষণা দেন। এ সময় কিছুটা বেকায়দায় পড়েন মিঠু। মিঠু একজনকে তিন কোটি টাকার গাড়ি দিলেও তিনি সেই গাড়ি নেননি। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ফেলেন। কর্মকর্তাদের আর্শীবাদে পুরো স্বাস্থ্যখাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হন মিঠু। ওই সময় মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরপর মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বদলি হয়ে আসলে তাকেও ম্যানেজ করে ফেলেন।

 

এই দুই কর্মকর্তা মিঠু সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিন জন পরিচালক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য। এরা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন। তাদের একজন অবসরে চলে গেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কোন কর্মকর্তাকে গাড়ি-বাড়িও করে দেন তিনি। মিঠু সম্প্রতি ৬৫ কোটি টাকা দিয়ে সরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে একটি মেশিন কিনে দিয়েছে। এটা অনুদান হিসেবে দিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতের লোকজন বলছে, মিঠুর এটি লোক দেখানো কাজ। এভাবে একটা অনুদান দেখিয়ে হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয় মিঠু।

আরো পড়ুন : অতি ধনীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশে

সূত্র জানায়, মন্ত্রী-সচিবসহ স্বাস্থ্যখাতের উপরের প্রশাসনিক পদগুলোতে যখন যিনি আসেন তিনিই মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। এছাড়া নিচের পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত।

 

মিঠু সিন্ডিকেটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত আছেন একজন সহকারী সচিব। তিনি ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ছিলেন। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একই শাখায় পদ দখল করে রেখেছেন। আর মিঠুর কারণে এই কর্মকর্তার অন্য কোথাও বদলি করা যায় না। মন্ত্রণালয়ে মিঠুর হয়ে খুঁটিনাটি কাজগুলো সব দেখভাল করেন এই সহকারী সচিব।

 

জানা গেছে, মিঠুর সিন্ডিকেটে স্থায়ী সদস্য হিসেবে আরো আছেন— কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের এক কর্মকর্তা, খুলনাস্থ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের একজন উচ্চমান সহকারী প্রমুখ।

 

এই সিন্ডিকেটের কারণেই আবজাল হোসেন এত অর্থ সম্পত্তির মালিক হন। জানা গেছে, নির্বাচনে আগে স্বাস্থ্য খাতে ৮৫ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মিঠুর সিন্ডিকেট ঠিকাদারের সঙ্গে মিলে সরকারি পাঁচ হাসপাতালের নামে এই টাকা লোপাটের সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের হস্তক্ষেপে শেষ মুহূর্তে সিন্ডিকেটটির এই অপতত্পরতা ভেস্তে যায়।

 

দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি ইউনিটে ভয়াবহ দুর্নীতি হলেও এ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। সাবেক ও নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিও কাজে আসছে না। বহাল তবিয়তে রয়েছে সিন্ডিকেট সদস্যরা।

 

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে কোন দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। যারা জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, মিঠুকে আমি দেখিনি, চিনিও না।

 

ইত্তেফাক/ইউবি