বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অণুগল্প

রোগশয্যায়

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:১২

 

একটা অদ্ভুত দুলুনি। দুলছি, নৌকার দোলার মতো। এটা কি বৈতরণী নদী? পার হতে হবে ওপারে যেতে হলে? ওপারে কি যেতেই হবে?

কারা যেন কথা বলছে। সেসব কথা শোনাচ্ছে ফিসফিসানির মতো। আমি ঘুমিয়ে আছি, নাকি সংজ্ঞাহীন—বুঝতে পারছি না। তন্দ্রার কুয়াশা কেটে একটু যখন পরিষ্কার হয় মাথা, বুঝতে পারি নদী পার হচ্ছি আমি। পদ্মা নদী। আহা পদ্মা! আমার যখন বইয়ের দোকান ছিল তখন একবার বাংলাবাজার থেকে নতুন বছরের পাঠ্যবই কিনে সদরঘাট থেকে লঞ্চে তুলে দিলাম। পদ্মায় লঞ্চডুবি হলো। ডুবে গেল আমার সব পুঁজি...।

আমি দুলছি, ফেরির দুলুনি কি? আমার মুখে অক্সিজেনের মাস্ক। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কণার কথা ভেসে এল কানে হঠাত্। কোথায় কণা? আমি এদিক-ওদিক তাকাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘাড় যেন আমার শক্তপাথর হয়ে গেছে। বিবশ লাগে কেমন, মনে করতে পারি না আর কিছু।

তখনও অন্ধকার, নাকি আলো আছে কোথাও? কে এসে বলল, বাবা আমি অর্জুন। কেমন লাগছে এখন?

আমি ফ্যাসফেসে গলায় বললাম, ভালো।

অর্জুন, আমার প্রিয়তম সন্তান, ওকে দেখে আমার মনটা ভরে গেল। চোখের দুকোণে গরম জল অনুভব করলাম। অর্জুন আরো কাছে এসে বলল, কাঁদছ কেন বাবা? বড় হসপিটাল। বড় বড় ডাক্তার, তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।

আমি এ-সময় কাশলাম খুব। রক্তে ভরে গেল আমার মুখ। নার্স ছুটে এল...।

কোথা দিয়ে দিন যায়, রাত পার হয়, বুঝতে পারি না। একদিন রাতে কণার খুব কান্না শুনতে পাই। একদম মরাবাড়ির কান্নার মতো। আমার খুব মন খারাপ হলো। সকালে যখন অর্জুন এল, তখন বললাম, তোর মা-র কান্নায় সারা রাত ঘুমাতে পারি নাই।

অর্জুন খুব অবাক হলো, না, মা তো এখানে ছিল না বাবা।

নার্স এসে বললেন আমার পাশের বেডে এক বয়স্কা মহিলা রোগী নাকি সারা রাত কেঁদেছেন!

অর্জুন পরম মমতায় আমার হাত ধরল। আমি আবার চোখের কোণে গরম জল অনুভব করলাম। শেষ কবে কেঁদেছি, জানি না। কিন্তু অর্জুনের স্পর্শ আমার ভেতরটা নিংড়ে নিচ্ছে। আমার মনে হলো অর্জুনের এই স্পর্শ আমি আর পাব না।

শেষ বিকেলটা খুব মনে পড়ে। যেন লঞ্চডুবি ঘটেছে, আমার বইগুলোর সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছি আমি, একফোঁটা বাতাস নিতে পারছি না। ডাক্তারদের সঙ্গে অর্জুন উদ্বিগ্নমুখে কীসব কথা বলছিল, ছোটাছুটি করছিল। আমাকে আইসিইউ-তে নেওয়া হলো। অর্জুন এসে আমার হাত ধরল। বুকের ভেতরটা যেন জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল।

রাত তখন কত—আমি জানি না। আমি যন্ত্রের জালে আটকা, কেউ নেই পাশে। বউ ছেলেমেয়ে কেউ নেই। মনে হলো যেন ফেটে গেল হূদপিণ্ড। কারা যেন ছোটাছুটি করতে শুরু করল। বিদ্যুতের ঝাঁকুনিতে কেঁপে কেঁপে উঠলাম আমি...।

অর্জুন ছিল না কোথাও। কিন্তু অর্জুন এসে আমার হাত ধরল। স্বপ্ন, নাকি সত্যি? আমার জন্য অর্জুনের কষ্ট আমাকে তোলপাড় করে ফেলল। আমি জানি আমাকে ও কতটা ভালোবাসে। অর্জুন ফিসফিস করে আমার কানের কাছে এসে বলল, আবার দেখা হবে বাবা।

তাই তো! আবার তো দেখা হতেই পারে! কিন্তু আমি জানি, এটা ওর সান্ত্বনাবাক্য! অন্ধ ভালোবাসা ভাসিয়ে নেয় সব দর্শন-তত্ত্ব!