শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অভিবাসী শ্রমিকের লাশ হইয়া ফেরা

আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ২১:৪৩

বাংলাদেশি কর্মীরা ভাগ্য ফিরাইতে দলে দলে বিদেশে যান। কিন্তু প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়িয়া নিঃস্ব হইয়া ফিরিতেছেন অনেকে, অনেকে আবার লাশ হইয়া। গত বত্সর রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হইয়াছে। ২০১৮ সালে মোট ৩ হাজার ৭৯৩ বাংলাদেশি কর্মীর মৃতদেহ দেশে আনা হইয়াছে, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭ অভিবাসী কর্মীর মৃতদেহ আসিয়াছিল। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে অবৈধভাবে কর্মরত ১১৭ কর্মীর মৃতদেহও আসিয়াছে। এই সংখ্যা গত ১৪ বত্সরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের অধিক কর্মীর মৃতদেহ দেশে আসিয়াছে। এই হিসাবে, গত এক যুগে এই সংখ্যা ৩৫ সহস্রাধিক।  বেশিরভাগ মৃতদেহ আসিয়াছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি হইতে। সবচাইতে বেশি মৃতদেহ আসিয়াছে সৌদি আরব হইতে, দ্বিতীয় সর্বাধিক মৃতদেহ আসিয়াছে মালয়েশিয়া হইতে।

গত চার বত্সরে যত প্রবাসীর লাশ আসিয়াছে, তাহাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করিয়া দেখা যাইতেছে যে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হইয়াছে আকস্মিকভাবে—মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অথবা হূদরোগে। তাহাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২৫ হইতে ৩৫ বত্সরের মধ্যে। সেইসঙ্গে, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও সড়ক দুর্ঘটনায়ও প্রাণ হারাইতেছেন অনেকে। ফলে, এইসকল মৃত্যুকে অস্বাভাবিকই বলিতে হইবে। অল্প বয়সে স্ট্রোকে এবং হূদরোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ অতিরিক্ত মানসিক চাপ। শ্রমিকরা সর্বস্ব বিক্রি করিয়া প্রবাসে যান অনেক বড় প্রত্যাশা নিয়া। কিন্তু সেখানে গিয়া তাহারা চরম হতাশায় পড়েন। অনেকেই ঋণ করিয়া বিদেশে যান, সেই টাকা তুলিতে দিনে ১২ হইতে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করেন। কিন্তু দেখা যায়, যেই অর্থ খরচ করিয়া গেছেন তাহার তুলনায় আয় খুবই কম। ফলে ঋণ পরিশোধের একটা চাপ সবসময় থাকে। তদুপরি, প্রতিকূল কর্মপরিবেশ, স্বল্প জায়গায় গাদাগাদি করিয়া বসবাস, নিম্নমানের খাদ্য এবং দীর্ঘদিনের স্বজন বিচ্ছিন্নতাও এই ধরনের মৃত্যু ত্বরান্বিত করিতেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে কথা বলা হইতেছে, তাহার পিছনেও শ্রমিকদের কাজের প্রতিষ্ঠানগুলির দায় আছে। শ্রমিকদের এক স্থান হইতে অন্যত্র পরিবহনের জন্য বাস বা ট্রাকে গাদাগাদি করিয়া বা ঝুলাইয়া নিয়া যাওয়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়ার মতো দেশে অহরহ ঘটিতেছে।

এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক এখন বিদেশে কর্মরত এবং প্রতিবত্সর দক্ষ-অদক্ষ প্রায় ৫ লক্ষ শ্রমিক বিদেশে যাইতেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের মধ্যে ৮১ শতাংশ আছেন মধ্যপ্রাচ্যে এবং ১১ শতাংশ আছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকার অন্যতম চালিকাশক্তি হইল প্রবাসীদের কষ্টার্জিত আয়। দেশের জিডিপির ১২ শতাংশই তাহাদের অবদান। অথচ, তাহাদের জীবনের নিরাপত্তা ও উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করিতে যথেষ্ট উদ্যোগ দৃশ্যমান নহে। সাধারণত, কর্মীদের মৃতদেহ দেশে আনিবার পরে কখনো ময়না তদন্ত করা হয় না। ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণও জানা যায় না। সরকারের উচিত মৃতদেহ দেশে আসিবার পরে ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করা এবং সমস্যা নির্ধারণ করিয়া সমাধানের পথ খোঁজা। অভিবাসন খরচ কর্মীদের মানসিক চাপের অন্যতম কারণ। অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনিতে পারিলে ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে বলিয়া সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিদেশে কর্মীদের উন্নত কর্মপরিবেশ এবং থাকা-খাওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করিতেও সরকারের দায়িত্ব রহিয়াছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর্মীরা বেতন-ভাতা পাইতেছেন কিনা তাহাও দেখা জরুরি। আমরা আশা করিব, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলি অভিবাসী শ্রমিকের অনভিপ্রেত মৃত্যুরোধে সম্ভাব্য সবকিছুই করিবেন।