শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জেব্রা ক্রসিংয়েই ছাত্রকে পিষে মারলো বাস

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০১৯, ২২:৪৭

আবারও সড়কে ঝরল তাজা প্রাণ। এবার গাড়ির চাকায় পিষ্ট হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্র। ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭ টার দিকে রাজধানীর প্রগতি সরণিতে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। পথচারী পারাপারের জন্য নির্ধারিত স্থান জেব্রা ক্রসিংয়ের উপরই সুপ্রভাত পরিবহনের একটি ঘাতক বাস চাপা দেয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে (১৯)। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় বাসচালক সিরাজুলকে আটক করা হয়েছে।

এদিকে আবরার নিহত হওয়ার ঘটনায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রগতি সরণির কুড়িল থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত ছয়টি জায়গায় সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ শুরু করেন। আট দফা দাবিতে দিনভর বিক্ষোভ করে সন্ধ্যায় তারা অবরোধ স্থগিত করেন। তবে আজ বুধবার আবার তারা রাজধানীর সড়কজুড়ে অবরোধ করবেন বলে জানিয়েছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ক্লাস বর্জন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে সড়ক অবরোধের আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনরা জানিয়েছেন, সকাল ৭ টার দিকে আবরার ও তার বাবা বাসা থেকে এক সঙ্গেই বের হয়ে যমুনা ফিউচার পার্কসংলগ্ন প্রগতি সরণিতে আসেন। ওখান থেকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর বাসে করে আবরারের ক্যাম্পাসে যাবার কথা। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবরার নিয়ম মেনেই জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এসময়  সুপ্রভাত পরিবহনের বাসটি (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫) অন্য একটি বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে রাস্তা পারাপাররত আবরারকে প্রথমে ধাক্কা দেয়। এতে আবরার পড়ে গেলে চালক বাসটি তার ওপর দিয়েই চালিয়ে দেন। তাকে চাকায় পিষ্ট করে খানিকটা টেনেও নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আবরার। এসময় আশপাশের লোকজন ওই বাসটিকে ধাওয়া দিলে চালক কিছু দূরে গিয়ে বাসটি রেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে বাসটি জব্দ ও চালককে আটক করে।

দিনভর সড়ক অবরোধ:আবরারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তাত্ক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে প্রগতি সরণির কুড়িল থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত ছয়টি জায়গায় সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে বেসরকারি নর্থ সাউথ, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও  আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষ সড়কে অবস্থান নিয়ে ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। এসময় শিক্ষার্থীরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আবিরের বুকে রক্ত কেন?’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হোক’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকেন। আন্দোলন চলাকালে বেলা সাড়ে ১০ টার দিকে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস ওই সড়কে আসে। তখন বাসটিতে দুই ব্যক্তি আগুন দিলে ধোঁয়া বের হতে থাকে। তখন বিইউপির শিক্ষার্থীরা ওই দুই ব্যক্তিকে ধাওয়া দিলে একজন পালিয়ে যায়। আরেকজনকে ধরে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।  বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরাই বাসটির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ছাত্রদের বক্তব্য, দাবি আদায়ে তাদের আন্দোলন অহিংস। সেখানে পরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পরিকল্পিতভাবে বাসে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আগুনে বাসটির দুটি সিট পুড়ে গেছে।

মেয়রের আশ্বাসেও অনড় শিক্ষার্থীরা:ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বেলা সাড়ে ১০ টার দিকে আন্দোলনরত  শিক্ষার্থীদের কাছে যান। তিনি ঘাতক চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সড়ক নিরাপত্তায় নানা ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধে অনড় থাকেন। মেয়র শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক উল্লেখ করে বলেন, রাজধানী ঢাকায় কোনো রুটেই সুপ্রভাত বাস চলবে না। সুপ্রভাতের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এছাড়া নিহত শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর নামে প্রগতি সরণিতে তিন মাসের মধ্যে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।  শিক্ষার্থীদের দাবির ব্যাপারে মেয়র বলেন, এ ঘটনায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। তাদের সঙ্গে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করা হবে। পর্যায়ক্রমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামানোর জন্য পার্কিং করে দেব। এ ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাসের মালিকদের সংযুক্ত করা হবে। এ কাজটি আমরা দ্রুত করব। বাসচালকের বিচারের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, চালকের বিচার করতেই হবে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার সর্বোচ্চ বিচার হবে। এসময় তিনি অবরোধ প্রত্যাহারের আহবান জানালেও শিক্ষার্থীরা অবরোধ চালিয়ে যান।

শিক্ষার্থীদের পাশে ভিপি নুর:আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে বিকাল সাড়ে ৪ টার দিকে রাজধানীর নর্দ্দায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সড়কে অবস্থান নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যান। এই আন্দোলনে আঘাত করা হলে ‘দাত ভাঙা’ জবাব দেওয়া হবে। নুর আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী হামলা চালানো হয়েছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বানচালে বিভিন্ন মহল ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। ছাত্রসমাজকে সচেতন থাকতে হবে।

অবরোধ স্থগিত: আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে সরে যেতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনুরোধ করলেও তারা বিকাল পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যান। বিকালের দিকে ডিএমপির জয়েন্ট কমিশনার (ট্রফিক উত্তর) মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম ও উপ-কমিশনার (গুলশান) মোস্তাক আহমেদ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় জয়েন্ট কমিশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমাদের মতো আমরাও ব্যথিত। ঘটনার পরই আমরা ঘাতক বাস ও চালককে আটক করেছি। তোমরা নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করছ, আমরাও এতে অনুপ্রাণিত। কারণ আমরাও নিরাপদ সড়ক ও যানজটমুক্ত রাজধানীর জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের একটু সময় দাও।’ পরে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করেন।

ক্লাস বর্জন করে অবরোধের ডাক: সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ শেষে সাংবাদিকদের পরবর্তী কর্মসূচি জানিয়ে বিইউপি শিক্ষার্থী মায়েশা নূর বুধবারের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। মায়েশা নূর বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত আমাদের সড়ক অবরোধ কর্মসূচি চলেছে। আজ বুধবার থেকে আমাদের আন্দোলন চলবে। আজ সকাল ৮ টা থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন করার আহ্বান জানাচ্ছি। আপনারা আপনাদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস বর্জন করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সড়কে অবস্থান নেবেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের এই আন্দোলন গতবছরের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আমাদের এই আন্দোলনে গতবছরের মতো কোনও হামলা ও রক্তাক্ত চেহারা দেখতে চাই না। আমরা পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপত্তা চাই। আমাদের আন্দোলনের সময় আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে মায়েশা নূর বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আটদফা দাবি দিয়েছি। আমাদের এই আন্দোলন কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন না। আমাদের এই আন্দোলনে রাজনৈতিক কোনও দল বা ব্যক্তিকে গ্রহণ করবো না। সবাই নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেবেন। আমরা আমাদের অভিভাবকদেরও এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি।

শিক্ষার্থীদের আট দফা :১. পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং প্রতি মাসে বাসচালকের লাইসেন্সসহ সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে। ২. আটক চালক ও সম্পৃক্ত সবাইকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ৩. আজ থেকে ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুত সময়ে অপসারণ করতে হবে। ৪. ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সব স্থানে আন্ডারপাস, স্পিড ব্রেকার এবং ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। ৫. চলমান আইনের পরিবর্তন করে সড়ক হত্যার সাথে জড়িত সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ৬. দায়িত্ব অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৭. প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রী ছাউনি করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ৮. ছাত্রদের হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) অথবা আলাদা বাস সার্ভিস চালু করতে হবে।

আবরারের দাফন:নিহতের পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দুপুরে বিইউপির এডিবি গ্রেড গ্রাউন্ড মাঠে আবরার আহামেদ চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বনানী সামরিক করবস্থানে আববারকে দাফন করা হয়। জানাজায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, বিইউপির উপাচার্য মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী, উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আবুল কাশেম মজুমদারসহ বিইউপির সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীবৃন্দ, নিহতের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন এবং সহপাঠীরা উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, আবরার আহামেদ চৌধুরীর বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফ আহমেদ চৌধুরী (অব.) এবং মা ফরিদা ফাতেমী। দুই ছেলের মধ্যে আবরার বড় সন্তান ছিলেন। আবরার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল পাশ করে গত বছর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (আইআর) বিভাগে ভর্তি হন। আর ছোট ছেলে আবীদ আহমেদ চৌধুরী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। বসুন্ধরা ডি ব্লকের একটি ভাড়া বাসায় তারা থাকেন।

ঘাতক বাসের নিবন্ধন বাতিল:সুপ্রভাত পরিবহনের ওই ঘাতক বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫) নিবন্ধন সাময়িকভাবে বাতিল করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএ-এর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মো. রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘বাসটিকে বন্ধ করে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরাও তার সঙ্গে একমত। ওই বাসের মালিক পক্ষকে ডেকে এনে আমরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছি।’