শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বপ্ন ছোঁয়ার চেষ্টা

আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:২৩

বাড়ি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীতে এসেছিলেন ফাতেমা তুজ জহুরা মীম। ভর্তি কোচিং করা, দেশের নানা প্রান্তে ভর্তি পরীক্ষা শেষে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন হোম ইকোনমিক্স কলেজের শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগে। ‘ইচ্ছা ছিল ভালো কোনো বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। তা যখন হলো না, তখন এই বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, এই বিষয়ে পড়লে ক্যারিয়ার ভালো হওয়ার সুযোগ থাকে। এনজিও, সরকারের মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়েও চাকরির সুযোগ পাওয়া যায়’- বলছিলেন মীম।

শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে— কর্মমুখী নাকি নিজের সৃষ্টিশীলতা নির্ভর। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়লে জীবনে প্রতিষ্ঠা এমনিতেই হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে ভর্তি সবসময় নিজের ইচ্ছার অধীন থাকে না। এর পাশাপাশি পড়াশোনা শেষ করে জীবনে প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে এখনকার তরুণরা ভালো বেতনের চাকরি মিলবে যে খাতে সেই বিষয়ে পড়ার দিকে ঝোঁকে। দেশে এখন এমবিএ ও এসিসিএ পড়ার জোয়ার বইছে। দেশে ব্যবসা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকায় এবং দেশি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা আন্তর্জাতিক বাজারে ছড়িয়ে পড়ায় ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে পড়াশোনা করে আসা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন পড়ছে। পড়াশোনা শেষ করে যখন দ্রুত ভালো চাকরি পেয়ে যাচ্ছে তখন পরবর্তী শিক্ষার্থীদের সামনে সেটাই একটা লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে - জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার। তাই যেসব বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর সঙ্গে সঙ্গে চাকরির বাজারে প্রবেশের সুযোগ নেই সেসব বিষয় ‘অকাজের’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের বিষয়গুলো খুব একটা পড়ানো হয় না।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নুরুল হক বলছিলেন, ‘আমরা যখন ছাত্র সেই পঞ্চাশ ষাটের দশকে ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে বাংলা ইংরেজি দর্শন বিষয়ে পড়তে আসত। এখন এসব বিষয়ে পড়ার আগ্রহ একবারেই দেখি না। না পারতে সবাই এসব বিষয়ে ভর্তি হয় এখন। আর ছেলেমেয়েদেরও দোষ দেয়া যায় না, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রের সিস্টেমটা এমন দাঁড়িয়েছে চাকরিমুখী পড়াশোনাটা আমাদের সন্তানদের জন্য ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

শিক্ষাবিদরা বলছেন, আমাদের প্রচলিত মুখস্থবিদ্যার শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যদিয়ে শিক্ষায় গুণের প্রকাশ পায় না। মুখস্থ করতে পারা স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে। কিন্তু মূল শিক্ষা হচ্ছে সৃজনশীল। অর্থাত্ একজন শিক্ষার্থী যা পড়ছে তা নিজের ভাষায় তা প্রকাশ করতে পারছে কিনা? তার পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলো সে পড়তে পারছে কিনা? সমস্ত পৃথিবীকে তার জানার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে কি না? এবং সে যে বিষয়গুলোর উপর পড়াশোনা করেছে তার উপর সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে কিনা? এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের হাতে জিপিএ ফাইভ এবং এ জাতীয় যে সনদগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে তাতে যে খুব মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে তা বলা যাবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের শিক্ষার সংকটের মূলে আছে শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বলা হতো, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে।’ এ দৃষ্টিভঙ্গির একটি বড় গলদ হলো জ্ঞানকে কর্ম সম্পাদনের দক্ষতার পর্যায়ে নামিয়ে আনা। আমাদের সমাজ শিক্ষাকে একটি সুযোগ বলে ভাবে, অধিকার হিসেবে ভাবে না। এখনো না।

সারাবিশ্বে শিক্ষা ও সৃজনশীল শিক্ষার ধারণা বদলে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পর্যায়ের চাকরির খাত আগামী ২০ বছরে ৪৭ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়বে। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইন্সটিটিউট জানাচ্ছে, আজকের তথ্যপ্রযুক্তির কর্মীরা যে কাজ করছে তার ৪৫ শতাংশ কাজ কম্পিউটারাইজড করে ফেলা সম্ভব। সেটা যদি সম্ভব হয় তাহলে এই খাতের কর্মীরা চাকরি হারাবে।

এই যদি হয় অবস্থা তাহলে, ভবিষ্যতের তরুণরা কি করবে? কি বিষয়ে পড়বে? কি ধরনের চাকরি বা ব্যবসা তারা করবে? সমীক্ষা বলছে, ভবিষ্যতে চাকরির বাজার বা অর্থপূর্ণ উত্পাদনশীল কাজে মানুষের সৃজনশীলতা, কৌতূহল, কল্পনাশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। উদ্ভাবনমূলক অর্থনীতিতে নতুন উদ্ভাবন ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হবে মানবীয় আবেগ এবং কল্পনাশক্তি।

ওই সমীক্ষায় এও বলা হচ্ছে, সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলে ফেলতে হবে। দুই দশক পরে যে সমস্যা বিশ্বজুড়ে দেখা দেবে তা মোকাবিলায় স্কুল মডেল বদলানোর বিকল্প নেই। মুখস্ত বিদ্যা, পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে উদ্ভাবনমূলক সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক ও সিলিকন ভ্যালিতে ব্যবসা সম্প্রসারণে পরামর্শক জন হেগেল বলছেন, তোমার পছন্দের ক্ষেত্র খুঁজে বের করো। খুঁজে বের করো যা তুমি সত্যিই পছন্দ করো। তুমি তোমার সেই আগ্রহের পেছনে ছোট যতক্ষণ তুমি তোমার লক্ষ্যে না পৌঁছাচ্ছ। একবার যদি তুমি তোমার স্বপ্নের দেখা পাও, তাহলে সেই স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার পথ সৃষ্টি করো। কারণ তোমার জীবনে এটাই সেই পথ যা নতুন পৃথিবীর জন্ম দিতে চলেছে।

এই অবস্থায় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কোন পথে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের শ্রেণিকক্ষে শুধু মুখস্থবিদ্যা চর্চা হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে বেশিদূর যাবে না। তাই বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া জরুরি। যেখানে জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে পৃথিবীর জন্য তৈরি করা হবে। সেখানে একজন শিক্ষার্থীকে নানা বিষয়ে গভীর জ্ঞান দেওয়া হবে। তার দৈনন্দিন পড়ার বিষয়ের পাশাপাশি প্রকৃতি, জীবন, সমাজ ইত্যাদি বিষয়েও জানাতে হবে এবং তাকে প্রকাশের এবং যোগাযোগের জন্য যা যা দক্ষতার দরকার সেই ধরনের সব শিক্ষা দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের ভাষা দক্ষতা শূন্যের কোঠায়। নিজের মাতৃভাষায় দক্ষতা নেই আর অন্য ভাষার দক্ষতা তো বহু দূরের কথা। বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে টিকে থাকতে হলে ভাষার মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। আমাদের সেই দক্ষতা কোথায়? তাই, আমাদের ভাষার দক্ষতা, বিজ্ঞানের দক্ষতা, গণিতের দক্ষতা, প্রযুক্তির দক্ষতা নিতে হবে। কিন্তু বিশাল সংখ্যক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়গুলোর বাইরে রয়ে গেছে। একজন শিক্ষার্থী এমএ পাস করে বের হচ্ছে কিন্তু এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে জ্ঞান লাভ করছে না। কিন্তু বিদেশে তা হয় না। তাই বলব, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে যেখানে একজন শিক্ষার্থী কেবল এমএ পাসের সনদ নয়, জ্ঞাননির্ভর শিক্ষায় দক্ষ হয়ে পৃথিবীর জন্য তৈরি হবে।