শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিশুর মেধা বিকাশে বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি

আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:৩৭

সারাবিশ্বে সাধারণ শিক্ষা ও সৃষ্টিশীল শিক্ষার ধারণা বদলে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পর্যায়ের চাকরির খাত আগামী ২০ বছরে ৪৭ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়বে। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইন্সটিটিউট জানাচ্ছে, আজকের তথ্যপ্রযুক্তির কর্মীরা যে কাজ করছে তার ৪৫ শতাংশ কাজ কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে ফেলা সম্ভব অর্থাত্ কোনো জনশক্তির প্রয়োজন পড়বে না। সেটা যদি সম্ভব হয় তাহলে এই খাতের কর্মীরা চাকরি হারাবে।

এই যদি হয় অবস্থা তাহলে ভবিষ্যতের তরুণরা কী করবে? কী বিষয়ে পড়বে? কী ধরনের চাকরি বা ব্যবসা তারা করবে? সমীক্ষা বলছে, ভবিষ্যতে চাকরির বাজার বা অর্থপূর্ণ উত্পাদনশীল কাজে মানুষের সৃজনশীলতা, কৌতুহল, কল্পনাশক্তি এবং আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে প্রাধান্য দেয়া হবে। উদ্ভাবনমূলক অর্থনীতিতে নতুন উদ্ভাবন ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হবে মানবীয় আবেগ এবং কল্পনাশক্তি। ওই সমীক্ষায় এও বলা হচ্ছে, সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলে ফেলতে হবে। দুই দশক পরে যে সমস্যা বিশ্বজুড়ে দেখা দেবে তা মোকাবেলায় স্কুল মডেল বদলানোর বিকল্প নেই। মুখস্ত বিদ্যা, পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে উদ্ভাবনমূলক সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক ও সিলিকন ভ্যালিতে ব্যবসা সম্প্রসারণে পরামর্শক জন হেগেল বলছেন, তোমার পছন্দের ক্ষেত্র খুঁজে বের করো। খুঁজে বের করো যা তুমি সত্যিই পছন্দ করো। তুমি তোমার সেই আগ্রহের পেছনে ছোট যতক্ষণ তুমি তোমার লক্ষ্যে না পৌঁছাচ্ছ। একবার যদি তুমি তোমার স্বপ্নের দেখা পাও, তাহলে সেই স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার পথ সৃষ্টি করো। কারণ তোমার জীবনে এটাই সেই পথ যা নতুন পৃথিবীর জন্ম দিতে চলেছে।

এই অবস্থায় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কোন পথে রয়েছে?

দেখা যাচ্ছে, শিশুদের মেধা বিকাশে শিক্ষা কার্যক্রম কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না। মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর পাঠ্যসূচি শিশুদের স্বাভাবিক শিক্ষাগ্রহণে বরং বাধার সৃষ্টি করছে। গ্রাম পর্যায়ে সরকারি স্কুলগুলোতে তো কথাই নেই, দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে মেধা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই।  এ বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিকে কী ঢেলে সাজানো প্রয়োজন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের শিক্ষানীতি একটি বিশ্বমানের শিক্ষানীতি। এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে আমাদের শিক্ষার মানের যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিশুদের মেধা বিকাশে মুখস্ত বিদ্যার বাইরের কিছু প্রয়োজন। আমাদের সাধারণ শিক্ষা পদ্ধতি তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, একটি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির যতটা চিন্তা অভিভাবকরা করেন কিন্তু তার মেধার বিকাশ ঘটছে কিনা, সে নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে তাদের ততটা দেখা যায় না। শুধু অভিভাবক কেন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও একটি শিশুর মেধা বিকাশের দিকে খুব একটা নজর নেই। একজন শিক্ষার্থীর মেধাবী হওয়ারও তেমন প্রয়োজন নেই। কেননা, আমাদের দেশে মুখস্ত বিদ্যার অনেক দাম। কিন্তু টেকনিক্যাল বিদ্যার কোনো দাম নেই। কারণ পাঠ্যসূচিকে এমনভাবে গঠন করা হয়েছে গত্বাধা মুখস্ত না করলে কোনোভাবেই ভালো ফলাফল করা সম্ভব নয়। এমনকি লেখাপড়াকে আনন্দদায়ক করে উপস্থাপনেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। কঠিন এবং নতুন বিষয়ের প্রতি শিশুদের ভীতি সহজাত। সেই বিষয়টিকে আনন্দ দিয়ে শেখানোর পদ্ধতিও নেই। বরং এক নিদারুণ অপমান ও বিভীষিকাময় চাপ তৈরি করা হয় কেউ যদি পড়া না বুঝতে পারে।

নিলুফার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থী। চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার সময় সে দুটি বিষয়ে ফেল করলো। স্কুল থেকে নোটিস দেয়া হলো-পরের বছর এমন ফলাফল হলে বহিষ্কার করা হবে। মা-বাবা স্বাভাকিভাবেই উদ্বিগ্ন। কেন এমন হলো? তারা মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন, স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গেও কথা বললেন। জানলেন, মেয়ে একটু অমনযোগী। কেন এমন হচ্ছে এ বিষয়ে শিক্ষকরা কিছু বলতে পারছেন না। এরপর তাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন ছায়ানটের শিকড় কার্যক্রমে। দেখা গেল, অরিগ্যামি, মাটি দিয়ে নানা জিনিস বানানো, ছবি আঁকা এসবের প্রতি মেয়ের খুব আগ্রহ। সহশিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে সে খুব আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, স্কুলের পড়াশোনাতেও এর প্রভাব দেখা গেল। পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠেছে নিলুফার। এ সুযোগ ছিল না তার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। শুধু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই নয়, দেশের স্বনামধন্য স্কুলগুলোর কোনটিতেই এসব বিষয়ে ক্লাস করানোর সময় নেই। তারা আছেন বিষয়গুলোতে কীভাবে বেশি নম্বর তোলা যাবে — সেই সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টায়। শিশুদের মেধা বিকাশ, পড়ার প্রতি আগ্রহ এসব নিয়ে ভাববার কি সময় আছে কারোর!

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, শুধু স্কুল-কলেজের কারিকুলাম পড়লেই শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ হয় না। উন্নত দেশগুলোতে প্রত্যেকটা বিষয়ের আলাদা লাইব্রেরি থাকে। একটি বিষয় পড়ানোর সময় সেই বইয়ের পাশাপাশি সম্পূরক আরও অনেকগুলো বই পড়বার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই। যেসব স্কুলে লাইব্রেরি রয়েছে তারা ছাত্রদের ব্যবহার করতে দেয় না। অনেক স্কুলে তো লাইব্রেরিই নেই। ফলে বিকল্প শিক্ষার কার্যক্রম যারা চালান তারা শিক্ষা ব্যবস্থার সহায়ক শক্তি। খুব ভালো হতো যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই বিষয়গুলো থাকতো। কিন্তু তা যখন সম্ভব হচ্ছে না তখন এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা দেয়া জরুরি। আর এই কার্যক্রমগুলো শহরের চাইতে গ্রামে পৌঁছানো বেশি জরুরি। শহরে একজনের আগ্রহ থাকলে সে প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করতে পারবেন। কিন্তু গ্রামে সেটা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশ কার্যক্রমকে দেশব্যাপী একটি কাঠামোর ওপরে দাঁড় করাতে পেরেছে। এছাড়া ‘ফুলকি’ নামের একটি সংগঠনও মেধা মননের বিকাশে স্কুলভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সম্প্রতি ছায়ানটের ‘শিকড়’ কার্যক্রমও শিশুদের দেশের সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর এক ভিন্নধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব কার্যক্রম আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সম্পূরক কার্যক্রম হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। তবে, ছায়ানটের বিকল্প ধারার শিক্ষা কার্যক্রম হচ্ছে ‘নালন্দা বিদ্যালয়’। প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোকে অবলম্বন করেই শিশুর মেধা বিকাশের কার্যক্রমকে সমন্বয় করে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এ প্রসঙ্গে ছায়ানটের সহ-সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, শিকড় পরিচালনা করা হচ্ছে মূলত শিশুদের সঙ্গে সংস্কৃতি ও প্রকৃতির পরিচয় ঘটানোর লক্ষ্যে। আমরা লক্ষ্য করেছি, এ কার্যক্রমে মূলত ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করছে। এ থেকে মনে হতে পারে, সেই শিক্ষা কার্যক্রমে দেশভাবনা, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির পরিচয় ঘটছে না বলেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আগ্রহী হচ্ছে। তবে নালন্দা পুরোপুরি বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি। প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবেই সংস্কৃতির পাঠ নিতে হচ্ছে। তারা শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শাহ আবদুল করিমের দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। দেশভাবনা, প্রকৃতি পরিচয় বাধ্যতামূলক। সেই সঙ্গে আমরা শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট টিউশন নিতে নিরুত্সাহিত করি। যারা করে তাদের স্কুলে রাখা হয় না। এই ধারায় আমরা খুব দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে ভিন্নভাবে গড়ে উঠছে।

অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বললেন, মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকে এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। এজন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক দরকার। শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দরকার। পাশাপাশি প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। কেননা, গ্রামের স্কুলগুলোর মান বাড়াতে হলে তদারকি, নজরদারি বাড়াতেই হবে।  শিক্ষানীতিতে সবকিছু বলা হয়েছে। তবে এই শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে। এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে যাবে। তিনি বলেন, পঞ্চম শ্রেণিতে যে দেশব্যাপী পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, এটা শিশুদের মাঝে বৈষম্য ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। এটা বন্ধ করা দরকার। ফলাফলমুখী শিক্ষাকে উত্সাহিত করছে এ পরীক্ষা। ফলে যাদের সামর্থ্য আছে তারা পাইভেট টিউটর রাখছে। কিছুটা হয়তো ফল ভালো করছে, এটা একই গ্রামের দরিদ্র ছেলেটির প্রতি মানসিক চাপ তৈরি করছে।