বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আমজাদ হোসেনের অসমাপ্ত যাত্রা

আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:০০

আমজাদ হোসেন চিরদিনের জন্য চলে গেলেন গত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮। বহু প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির মহাপ্রস্থানে শোকের কালো ছায়া নেমে এলো আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর চিকিত্সার জন্য ২০ লাখ টাকা এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া বাবদ ২২ লাখ টাকা দিয়েছেন। সেই মোতাবেক ব্যাংকক নিয়ে চিকিত্সার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হলেও তাকে ফেরানো গেল না। ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমজাদ হোসেন চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি রেখে গেলেন তার অমর সব সৃষ্টি—কী চলচ্চিত্রে, কী সংগীতে, কী নাটকে, কী সাহিত্যে, কী শিশুসাহিত্যে। একজন দক্ষ অভিনেতা হিসেবে তিনি দর্শক-হূদয় জয় করে নিয়েছিলেন বহু আগেই। ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জামালপুরে জন্ম নেওয়া এই কৃতি মানুষটি ১৯৬১ সালে মহীউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৭ সালে নিজেই নির্মাণ করেন ‘জুলেখা’ চলচ্চিত্রটি। এরপর ১৯৬৭ সাল থেকে চলচ্চিত্র জগতের আরেক কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। জহির রায়হান পরিচালিত ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’-এর কাহিনীকার ছিলেন আমজাদ হোসেন। এই চলচ্চিত্রে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেন।

স্বাধীনতার পর আমজাদ হোসেন ব্যতিক্রম ও জীবনঘনিষ্ঠ কিছু চলচ্চিত্র আমাদেরকে উপহার দেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, জন্ম থেকে জ্বলছি, দুই পয়সার আলতা, ভাত দে, কসাই, সখিনার যুদ্ধ, সুন্দরী বধূ, গোলাপী এখন ঢাকায়, গোলাপী এখন বিলেতে প্রভৃতি। জনপ্রিয় এসব চলচ্চিত্রের তিনি সফল কাহিনীকার এবং বেশ কিছু সংগীতও রচনা করেছেন নিজের মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে। তার লেখা কয়েকটি গানের কথা এখানে না বললেই নয়। সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠে ও আলাউদ্দিন আলীর সুরে—জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো আর কতদিন বলো সইবো, এমনও তো প্রেম হয় চোখের জলে কথা কয়, কত কাঁদলাম কত গো সাধলাম, একবার যদি কেউ ভালোবাস তো আমার নয়ন দুটি জলে ভাসতো, কী করে বলিব আমি আমার মনে বড় জ্বালা, আছেন আমার মুক্তার আছেন আমার বারিস্টার, কেন তারে আমি এত ভালোবাসলাম; সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ও আলাউদ্দিন আলীর সুরে, দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়, ভালোবাসি বলিব না আর, তুমি যদি সুখী হও আমি চলে গেলে, যদি গো তার দেখা পাইতাম নয়নজলে কথা কইতাম, আমি আছি থাকবো ভালোবেসে মরবো—এমন অসংখ্য গান অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়া শামীমা ইয়াসমিন দীবার কণ্ঠে ও আলাউদ্দিন আলীর সুরে ‘বাবা বলে গেল আর কোনোদিন গান কোরো না’ গানটি ছেলে-বুড়ো সবার মনে দাগ কেটেছে। এসব গান একটি কালকে অতিক্রম করেছে এবং বিশ্বাস করি যে কালাতিকাল অতিক্রম করবে।

আমজাদ হোসেন একটা সময় বিটিভির জন্য নিয়মিত ঈদের নাটক লিখতেন জব্বার আলীকে নিয়ে। তিনি নিজেই মূল চরিত্রে অভিনয় করতেন। আমরা প্রতি ঈদে জব্বার আলীকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। এত আনন্দ বোধ করি ঈদের অন্য কোনো নাটক দিতে পারেনি। ঈদের দিন জব্বার আলী হয় হাসপাতালে না হয় জেলখানাতে সেমাই খেতেন। সেই দৃশ্যটি ছিল মজার। মজার মানুষ আমজাদ হোসেন বিনোদন জগতে তার সকল মজা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন মানুষের আনন্দদানের জন্য। ‘ধারাপাত’ দিয়ে শুরু করা নাটক লেখার দক্ষতাকে ছাপিয়ে অন্যান্য লেখা যেমন গল্প-উপন্যাস, শিশুসাহিত্য রচনায় রেখেছেন অসামান্য অবদান। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে— ধ্রুপদী এখন ট্রেনে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভালোবাসা, আমি এবং কয়েকটি পোস্টার, রক্তের ডালপালা, মাধবী ও হিমানী, আগুনে অলংকার, ফুল বাতাসী, মাধবী সংবাদ, যুদ্ধে যাব, অবেলায় অসময়, উত্তরকাল, পরী নামা জোছনায় বৃষ্টি, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে—শীতের রাজা উহু কুহু, জন্মদিনের ক্যামেরা, যাদুর পায়রা, টুকটুক, ভূতের রাণী হিমানী, রঙিন ছড়া কৃষ্ণচূড়া, মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত কিশোর গল্প ইত্যাদি। এছাড়া তিনি কিছু জীবনীগ্রন্থ এবং কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসও রচনা করেছেন। শিশুসাহিত্যে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন দু’বার, পেয়েছেন ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে ১৯৯৩ সালে এবং অর্জন করেন স্বাধীনতা পুরস্কার। আমজাদ হোসেনের মতো এমন গুণী মানুষের কখনো মৃত্যু হয় না। তার কর্ম আমাদের পথ চলার পাথেয় হয়ে আছে। একজন স্বপ্নদ্রষ্টার সারাজীবনের স্বপ্নকে আমরা লালন করে তা সফল হতে দেবো এটাই হোক অঙ্গীকার। এমন মহত্ মানুষের চলে যাওয়াকে কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো বলতে পারছি না। অসমাপ্ত যাত্রা— ঠিক গোলাপী এখন ট্রেনের মতোই— দ্য এন্ডলেস ট্রেন।

n লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক ও শিশুসংগঠক