শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাহারি কাগজের ফুলের গল্প

আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ২১:৫১

প্রবাদ আছে—ছাগলে কি না খায়? এর সহজ উত্তর হলো—ঘুষ। ছাগল সবকিছু খেলেও ঘুষ খায় না। ঘুষ খাওয়াটা নিতান্তই মানুষের কারবার। মানুষ ছাড়া আর কেউ বা অন্য কোনো জীব ঘুষ খায় না। সেদিক থেকে বলা যায়, অন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্যই হচ্ছে—মানুষ ঘুষ খায়, অন্য কোনো প্রাণী খায় না।

অবশ্য মানুষ মাত্রই ঘুষ খায়—ব্যাপারটা এমন নয়। ঘুষ খাওয়ার জন্য আপনার কিছু ক্ষমতা থাকা চাই। সেটা ছোট হতে পারে বা বড় হতে পারে। তবে আপনাকে অবশ্যই ক্ষমতাবান হতে হবে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তি অথচ ঘুষ খায় না—এমনটি বর্তমান সমাজে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। অবশ্য ঘুষ ব্যাপারটাই এমন যে এটা প্রকাশ্যে কেউ ‘খান’ না। খেলেও স্বীকার করেন না। এ যেন নিষিদ্ধ নেশা। জরিপ চালিয়ে দেখুন লাখে একজন ঘুষখোর ব্যক্তিও খুঁজে পাবেন না।

আসলে ঘুষ এমন একটা জিনিস যা মানুষ খায় বটে, কিন্তু কেউ তা স্বীকার করে না, সাধারণভাবে তা দেখাও যায় না। আমাদের সমাজে কোনো ব্যক্তি ‘ঘুষখোর’, এটি প্রমাণ করা সহজ নয়। মোটের ওপর এটি একটি জটিল সম্পাদ্য। মহামতি চাণক্য বহু বছর আগে বলেছিলেন—‘মাছ কখন জল খায় আর রাজপুরুষ কখন ঘুষ খায়, এটা বোঝা সহজ কাজ নয়।’ একসময় শুধু রাজপুরুষরাই ঘুষ খেতেন। ইউনিয়ন বোর্ড অফিসের পাহারাদার, পিয়ন-ঝাড়ুদার পর্যন্ত ঘুষ খায়। রাজা-রাজড়াদের আমলে সাধারণ মানুষকে ঘুষ খেতে হয়নি। মোটা ভাত, মোটা কাপড় পেয়ে এমনিতেই তারা সুখে ছিল। মানুষ যখন থেকে লোভ-লালসা-মোহ দ্বারা পরিচালিত হতে শিখেছে, লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষতে শিখেছে, তখন তারা বিধি-নিষেধ, নিয়ম-পদ্ধতি, আইন-কানুনেরও জন্ম দিয়েছে। আর এ দুয়ের মধ্যে আসন গেড়েছে ‘ঘুষ’ নামক আপদটি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘুষ নিঃসন্দেহে একটি অভিনব সংযোগ।

ঘুষ ব্যাপারটির সঙ্গে দুটি পক্ষ জড়িত। একজন ঘুষ প্রদানকারী, অন্যজন ঘুষ গ্রহীতা। ঘুষ গ্রহীতা হচ্ছে ক্ষমতাবান। পক্ষান্তরে ঘুষদাতা হচ্ছে স্বার্থ-প্রত্যাশী। ক্ষমতাবানরা নগদ বাড়তি কিছু পেয়ে ‘স্বার্থ-প্রত্যাশীকে’ কিছু পাইয়ে দেন। এ বাড়তি কিছু পাওয়া এবং পাইয়ে দেওয়ার খেলাই হচ্ছে ঘুষ।

ঘুষ ব্যাপারটি যথেষ্ট গোলমেলেও বটে। কে ঘুষ খায়, কখন ঘুষ খায়, কীভাবে ঘুষ খায়, কেন ঘুষ খায়—এসব মৌলিক প্রশ্নের জবাব আজ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক-অর্থনীতিবিদ এমনকি মনোবিজ্ঞানী পর্যন্ত দিতে পারেননি। এগুলো এখনো পর্যন্ত আমাদের কাছে অপার রহস্য। পরশুরামের এক গল্পে পড়েছিলাম, ‘ঘুষগ্রাহী অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে পারেন না যে সে ঘুষ নিচ্ছে।’ তো ঘটনা যাই হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সমাজে ঘুষ প্রদান এবং ঘুষ গ্রহণ একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এদেশে চাকরিতে ঘুষ, লাইসেন্স-পারমিটে ঘুষ, আমদানিতে ঘুষ, রপ্তানিতে ঘুষ, সরকারি বরাদ্দ টাকা পেতে ঘুষ, ঠিকাদারিতে ঘুষ, বিমান-জাহাজ ক্রয়ে, তেলকূপ-গ্যাসক্ষেত্র লিজ দেওয়াতে ঘুষ, শিক্ষায় ঘুষ, স্বাস্থ্যে ঘুষ, নিরাপত্তায় ঘুষ, খুনের জন্য ঘুষ, খুন হলে পরে ঘুষ, বৈধ পাওনা আদায়ে ঘুষ, অবৈধ কিছু পেতেও ঘুষ—মোটের ওপর সবখানেই, সবক্ষেত্রেই শুধু ঘুষ আর ঘুষ। ঘুষ ছাড়া সামনে এগুনো কঠিন; পিছিয়ে আসাও অসম্ভব। এদেশে টিকে থাকতে হলে ঘুষ দিতেই হবে। পুলিশকে ঘুষ দিয়ে অপরাধীরা যেমন স্বাধীনভাবে দুষ্কর্ম করার অধিকার আদায় করে, ঠিক তেমনি নিরপরাধ ব্যক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে উেকাচ দিয়ে অথবা হয়রানি থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ পায়। সুকুমার রায় ‘ঘুষ খায় দারোগায়’ একথা লিখে ‘আইনি’ ভাইদের ঘুষ খাওয়াকে স্থায়ী স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন।

মানুষ কেন ঘুষ খায়—এর জবাবে আমার এক ফাজিল বন্ধু বলেছিল, খাবার জিনিস তাই খায়। এটা অবশ্য মেনে নেওয়া কঠিন। খাবার জিনিস হলেই কি খেতে হবে? বিষও তো অনেকেই খায়, তাই বলে কি বিষ খাদ্য পদবাচ্য? খাবি খাওয়া, গাল খাওয়া, মার খাওয়া, লাথি খাওয়া এগুলো না হয় আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে, তাই বলে ঘুষও খেতে হবে?

তবে যত কথাই বলি না কেন, ঘুষ হচ্ছে নেশার মতো। খেতে খেতে একসময় নেশা হয়ে যায়। আমাদের এলাকায় এক নামকরা ঘুষখোর ছিল। ভদ্রলোকের আসল নাম হারিয়ে গিয়েছিল। এলাকার মানুষ তাকে ঘুষ-বাবু বলেই ডাকতেন। সেটেলমেন্ট অফিসে তিনি সামান্য কেরানির চাকরি করতেন। কথিত আছে যে, তিনি সকালবেলা একটি খালি চামড়ার ব্যাগ নিয়ে অফিসে যেতেন। সন্ধ্যায় ব্যাগ ভর্তি করে বাড়িতে ফিরতেন। তাকে এমনই ঘুষের নেশায় পেয়েছিল যে, নিজের পরিবারের লোকজনের কাছেও তিনি ঘুষ চাইতেন। ঘুষ খাওয়ার চেয়ে ঘুষ দেওয়া কম কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন বা তাগিদ যতোই হোক, কাকে ঘুষ দিতে হবে, কতো দিতে হবে সেগুলো জটিল সমস্যা। সাধারণ নাগরিকরা ঠিক এগুলো ধরে উঠতে পারেন না: সাহসও পান না।

ঘুষের সঙ্গে যেহেতু অর্থ জড়িত সেহেতু এটা আসলে অর্থনৈতিক ব্যাপার। দিন যতো যাচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ততো মোটা হচ্ছে। ঘুষ গ্রহণ নিঃসন্দেহে আদর্শের বিকৃতি। আদর্শের এই বিকৃতি তখনই সম্ভব যখন সমাজে মূল্যবোধের শক্তি অন্তঃসারশূন্য হয়ে যায়। প্রাণহীন কঙ্কালের মতো সেটা অনড় হয়ে পড়ে থাকে। এ কথা সামাজিক নীতি ও আদর্শের আলোচনা প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার।

সামাজিক-অর্থনৈতিক-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ক্লান্ত বাঙালি জাতি আজ এক নৈতিক শূন্যতায় আচ্ছন্ন। এখানে জীবনের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে দেবার কোনো সামাজিক সান্ত্বনা নেই। অন্যদিকে রয়েছে এগিয়ে যাবার তথা উপরে উঠবার নিরন্তর হাতছানি। এমতাবস্থায় এগিয়ে যেতে হলে দরকার অসাধুতা। ল্যাং মারা সম্ভব না হলে প্রয়োজন অন্য কোনো ফাঁদ। এ ফাঁদ হচ্ছে ফাইল আটকে দেওয়া। এ ফাঁদে ঘুঘু ধরা খাবেই। এদেশে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না। এছাড়া রয়েছে আমলাতন্ত্র। তিনগজ জায়গা পাড় হতে একটি ফাইলের আঠারো হাত বদল হতে হয়। প্রতিটি হাত এক একটি বিশ্বস্ত চেকপোস্ট! মাল ছাড়ুন ফাইল নড়বে। না হলে নট নড়নচড়ন! ঘাটে ঘাটে জল ঢেলে তবেই যজ্ঞ।

আমাদের বর্তমান সভ্যতা হচ্ছে কাগজ সভ্যতা। আর কাগজ মানেই হচ্ছে ফাইল। আর ফাইল মানেই হচ্ছে ঘুষ। সুতরাং বর্তমান সভ্যতার সঙ্গে ঘুষ বাইসাইক্লিক অর্ডারে ঘুরে-ফিরে আসছে, আসবে। বর্তমানকালে আমরা অনেক পালটে গেছি—রূপ-জৌলুস-চাকচিক্য-ভোগ-লোভ এসব কিছু দিয়ে এক অদ্ভুত মায়ার জগত্ আমরা তৈরি করেছি। এই অলীক রঙিন পৃথিবীর দিকে আমাদের অভিযাত্রা। উচ্চভিলাষী মন সারাক্ষণ পেতে চায় ভোগবাদী জগতের পণ্যসামগ্রী। অথচ সাধ্যের সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। আরো আরো চাইতে চাইতে আরো আরো পেতে পেতে আর পাইয়ে দিতে দিতে সবাই মিলে অধঃপাতে যাওয়ার ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না।

পুঁজিবাদী সমাজে আধুনিকতার নামে সারাক্ষণই ভোগসর্বস্ব বিলাসবহুল জীবনের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অথচ এ ঠিকানায় পৌঁছানোর কোনো সহজ স্বাভাবিক পথ খোলা নেই। আমাদের আয়ের পথ সীমাবদ্ধ, অর্থের যোগান সীমিত। তাই সাফল্যের চোরাপথগুলো আমরা খুঁজে নিই সহজেই। ঘুষ, দুর্নীতির চোরাপথে বিচরণ করেই আমাদের তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। মধ্যবিত্ত বাঙালি খুব সহজেই বিবেক এবং নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অসাধু বনে যায়। নানা ফিকিরে কীভাবে কিছু বাড়তি পয়সা হাতিয়ে নেওয়া যায়—এ ব্যাপারে চলে নিয়ত প্রতিযোগিতা। এর ফলে মৃত্যু ঘটে মানবিক গুণাবলীর। আর বর্তমানে আমরা প্রত্যেকেই যেন কাগজের ফুল—বর্ণের বাহার আছে বাইরে, ভেতরে মনুষ্যত্বের গন্ধ নেই!

ব্যক্তির সাধ ও সাধ্যের সীমাকে জোর করে মেলাতে গিয়েই আসে ঘুষ দুর্নীতিসহ নানা আর্থিক অনাচারের বিষয়। এই সর্বগ্রাসী সংকট থেকে রেহাই পেতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন আর্থিক সামঞ্জস্য বিধান। সামঞ্জস্য প্রয়োজন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির। সামাজিক জীবনযাত্রার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের সমীকরণ প্রয়োজন। শুধু জল আর মল নয়, আরো কিছু—বিশেষত সমষ্টির কল্যাণে আত্মত্যাগ করার মন্ত্রে যদি গোটা জাতিকে উজ্জীবিত করা না যায় তবে ঘুষ নিয়ে ঘুষোঘুষি কখনই বন্ধ হবে না। মামুলি কথাবার্তা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আর ঘুষখোরদের শাস্তির কেতাবী ব্যবস্থা করলে কিছুই হবে না; যে গরু সেই গোয়ালেই রয়ে যাবে।

n লেখক : রম্যরচয়িতা