বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আমাদের এখন সামনে তাকানোর সময়

আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৯, ২১:৪১

মোস্তফা মোরশেদ

মার্চ মাস আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্ব বহন করে। ২০১৮ সালের মার্চ মাস দুটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এক. জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। দুই. বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমরা আমাদের পূর্বতন অর্থনৈতিক অবস্থান স্বল্পোন্নত দেশ হতে একধাপ এগিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। গত ১৬ মার্চ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত যোগ্যতা অর্জনের পথে এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ২০১৫ সালের জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতি অনুসারে আমরা নিম্ন-আয়ের দেশ হতে নিম্ন মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। তবে বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃতির চেয়ে জাতিসংঘের এ স্বীকৃতি অনেক বেশি তাত্পর্য বহন করে। বিশ্বব্যাংক শুধু মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের শ্রেণিবিন্যাস করে থাকে। পক্ষান্তরে, জাতিসংঘের শ্রেণিবিন্যাসে আর্থ-সামাজিক অনেক বিষয় উঠে আসে যা উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে অনেকাংশে উপস্থাপন করে।

উত্তরণের সুফল আলোচনা করলে অনেকগুলো বিষয় উঠে আসে। দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এ অর্জন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং বিশ্ব অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি বাড়বে যা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে যা উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো তৈরির পথ সুগম করবে। এতে শিল্পের আধুনিকায়নের পাশাপাশি উত্পাদিত পণ্যের বহুমুখীকরণ ঘটবে এবং উদ্যোক্তা ও শ্রমিক উভয়ের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটবে। তবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উপরের ধাপে উঠে গেলে এসব দেশ কী কী সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাস্তবতার নিরিখে সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়। মোটা দাগে, এসব দেশ চার ধরনের সুবিধা প্রাপ্ত হয়। প্রথমত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বিভিন্ন Special and Differential Treatment সুবিধা; দ্বিতীয়ত, GSP (Everything but arms) ও ডিউটি ফ্রি কোটা ফ্রি (DFQF) সুবিধা; তৃতীয়ত, আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ODA) এবং অন্যান্য উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সাহায্য এবং সর্বোপরি, জাতিসংঘে এসব দেশের অনুদান অনেক কম দিতে হয়। উত্তরণের ফলে ডব্লিউটিও’র কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আর অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া ডব্লিউটিও’র এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বাণিজ্য সহজীকরণের জন্য অনুদান পাবে না।

উত্তরণের সরাসরি প্রভাব মূলত রপ্তানি বাণিজ্যে পড়বে যা বাংলাদেশকে বিশ্ব বাণিজ্যে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিতে পারে। কারণ আমাদের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ইইউ আমাদেরকে ৯৭.৮ শতাংশ পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। এ সুবিধা হারালে আমাদের রপ্তানি আয়ে বড় প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৬.৭ শতাংশ ট্যারিফ দেওয়া লাগবে ফলে রপ্তানি ২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (মোট রপ্তানির প্রায় ৭-৮ শতাংশ) পর্যন্ত কমে যেতে পারে।  রপ্তানিযোগ্য পণ্যে ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়েও নতুন শর্ত আরোপ সাপেক্ষে রপ্তানি ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।

বিশ্বের উন্নত দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। আমাদের অর্থনীতিতে এ আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতার অবদান এখন মাত্র জিডিপির এক শতাংশ হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে এর ভূমিকা রয়েছে। উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের এ মুহূর্তে করণীয় কী? জিএসপি প্লাস নিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের আওতায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও সুশাসন বিষয়ে ইইউর শর্ত পূরণ করলে জিএসপি প্লাস নামে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যাবে। এছাড়া, বাজার সম্প্রসারণ এবং পণ্যে বৈচিত্র্য এনে দ্বিপাক্ষিক নতুন চুক্তির দিকে অধিক মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে।

২০১৯ সাল থেকে হিসাব করলে এলডিসি থেকে চূড়ান্তভাবে বের হবার জন্য বাংলাদেশ পাঁচ বছর ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সুবিধা ভোগ করার জন্য আট বছর সময় পাবে। আশা করা হচ্ছে, দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের মানোন্নয়ন হওয়ায় বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতায় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়বে। এ সময়ে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য উত্পাদনে বৈচিত্র্য আসবে বলেই আমার ধারণা। সর্বোপরি, এ মর্যাদা আমরা যোগ্যতার ভিত্তিতে অর্জন করেছি, এটি কারও করুণা নয়। বিশ্ব বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলো যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, এ উত্তরণের ফলে আমরা হয়তো তার কিছু কিছু হারাবো। কিন্তু আমাদের এখন সামনে তাকানোর সময়, যাতে সাহায্যের বদলে পদ্মা সেতুর মতো আমরা নিজেরাই সবকিছু করতে পারি। এজন্য বিশদভাবে একটা গবেষণা হওয়া খুবই জরুরি। আমাদের প্রকৃত লাভ-ক্ষতির সমীকরণ বের করে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হবার রোডম্যাপ এখনই তৈরি করতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি আশাবাদী। এর নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। গত মার্চের ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর কোনো নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যায়নি। বরং এ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আট শতাংশের বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১৭৫২ মার্কিন ডলার। বাকি দুটি সূচকের হালনাগাদ তথ্য নেই, তবে অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক বলেই প্রতীয়মান হয়। রপ্তানি আয়ের গতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক। লক্ষণীয় যে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর ধারণা করা হয়েছিল আমাদের রপ্তানি কমবে। কিন্তু রপ্তানিতে সেরকম কোনো সমস্যা হয়নি। এছাড়া, আমরা এখন জনমিতিক মুনাফা ভোগ করছি যেখানে কর্মক্ষম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ— যা ২০৩০ সালে ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে। জনমিতিক মুনাফা ও আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যার কারণে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে সার্বিক চাহিদার কোনো ঘাটতি নেই। ইতিহাস বলছে, একটা দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদার ঘাটতি থাকলে এগিয়ে যাওয়ার গতি স্থবির হয়ে যায় এবং এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সকল অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে বড় কারণ মোট চাহিদার ঘাটতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক সাফল্যের পিছনে সরকারি বিনিয়োগও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

শুরুতেই বলেছিলাম, মার্চ মাস আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্ব বহন করে। গত মার্চের আনন্দের সংবাদ দুটির পেছনে রয়েছে দৃঢ় অঙ্গীকার। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের নেপথ্যে সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনা ও দেশের মানুষের কঠোর পরিশ্রম নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ঠিক এমনিভাবে, বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শুরু থেকেই এ জাতির জন্য যে ত্যাগ আর কষ্ট স্বীকার করেছেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে। এ দুই অর্জনের পেছনে রয়েছে দেশের মানুষের কাছে দেওয়া বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ও দীর্ঘ সাধনা। আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের ম্যারাথন উন্নয়ন যাত্রায় প্রথম মাইলফলক। আমাদের আসলে অনেক পথ যেতে হবে। সরকারের ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নই হোক আমাদের মূল লক্ষ্য।

n লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক