শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দুর্বল হয়ে আঘাত হেনেছে ‘বুলবুল’

আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৯, ০২:০০

অবশেষে গতকাল শনিবার রাতে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। তবে এটি অতিপ্রবল থেকে শক্তি কমে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। গতকাল রাত সোয়া একটার দিকে এ প্রতিবেদন লেখার সময় ঘূর্ণিঝড়টি খুলনার সুন্দরবন ও তত্সংলগ্ন এলাকা অতিক্রম করছিল। এসময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় একটানা সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানার পর এর গতি কমতে শুরু করেছে। তাত্ক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এর আগে গতকাল রাতে ঘূর্ণিঝড়টি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশে আঘাত হানে।

এর আগে গতকাল আবহাওয়া অফিস থেকে মোংলা ও পায়রা বন্দরসহ খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ৯ জেলায়  (ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা) ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর—এই পাঁচ জেলায় ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। অপর দিকে উপকূলীয় ৯ জেলার ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের নেওয়া হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক এলাকায় বিদ্যুত্ সংযোগ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। শনিবার বিকাল পর্যন্ত ১৮ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ৫ হাজার ৫৫১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৮ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৭ জন মানুষকে আনতে সক্ষম হয়েছি।

অপর দিকে গতকাল দুপুর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম ও যশোরে বিমান চলাচল। মাওয়া ও আরিচা নৌপথে বন্ধ রয়েছে ফেরি চলাচলও। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে, পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে পরীক্ষাও। গতকাল রাত ১১টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক আয়শা খাতুন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ কিছুটা দুর্বল হয়ে রাত ৯টা নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূল (সুন্দরবনের পাশ দিয়ে) অতিক্রম শুরু করে। মধ্যরাতে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ক্রমশ দুর্বল হয়ে মধ্যরাত নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে থাকে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর-পূর্ব দিকে আট কিলোমিটার বেগে অগ্রসর হচ্ছে।

ইত্তেফাকের খুলনা অফিস জানায়, সুন্দরবন উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ঘূণিঝড় বুলবুল সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরে প্রথম আঘাত হানে।

খুলনা জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ জানান, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে প্রথম আঘাত হানে। তিনি বলেন, রাত পৌনে ১২টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর তত্সংলগ্ন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি আরো উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে এবং এসময় দুর্বল হয়ে শনিবার মধ্য রাত নাগাদ খুলনার সুন্দরবনের কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চর থেকে রাত পৌনে ১২টার দিকে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দীন আহমেদ জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রথম ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানে। তিনি বলেন, এ সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটারের মধ্যে। তবে জলোচ্ছ্বাস হয়নি। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২ থেকে আড়াই ফুট পানির উচ্চতা বেড়েছে। রাত ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবন দুবলার চর উপকূল অতিক্রম করছিল।

পিরোজপুর অফিস জানায়, গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে জেলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। এসময় তীব্র ঝড়ো হাওয়া না বয়ে গেলেও হালকা দমকা হাওয়া বিরাজ করে। জেলায় ‘বুলবুল’ ঝড়ের প্রকৃতি অনেকটা শান্ত ছিল। গতকাল রাত সাড়ে ১১টায় সাতক্ষীরা শ্যামনগর প্রতিনিধি জানান, রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ঝড়ের প্রকৃতি শান্ত ছিল। তবে রাত ১১টার দিকে বাতাসের গতিবেগ বাড়তে শুরু করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় রাতে উপকূলীয় ৫টি ইউনিয়নের মানুষ স্থানীয় ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

উপকূলীয় এলাকায় সরকার প্রস্তুত, ১৮ লাখ ২৬ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় সাতক্ষীরা খুলনাসহ সব উপকূলীয় এলাকায় সরকার প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। গতকাল রাতে সচিবালয়ে বুলবুল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকালে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী করণীয় ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও শুরু করেছে সরকার। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ৫৫৫১টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১৮ লক্ষ ২৬ হাজার ৫৫৭ জন মানুষকে আনতে সক্ষম হয়েছি।

নৌ ও বিমান চলাচল বন্ধ :

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর কারণে সারাদেশে নৌ-চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। একই সঙ্গে যশোর ও চট্টগ্রামে বিমান উঠানামাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল দুপুর থেকে। গতকাল রাতে রেলওয়ে থেকে জানানো হয়েছে, রাতে চলাচল করা দুর্যোগপূর্ণ এলাকার সব ট্রেন সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার গতিসীমায় চলাচল করবে। বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম-পরিচালক (ট্রাফিক) আলমগীর কবির জানিয়েছেন, ‘৭ নম্বর বিপদ সংকেত ঘোষণা করার পর আমরা সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছি।’ বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মাওয়া ফেরিঘাটে সীমিত আকারে ফেরি চলাচল করলেও সন্ধ্যার পর বন্ধ করা হয়েছে। একই অবস্থা আরিচায়ও। রাতে সেখানে ফেরি চলাচল বন্ধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

আশ্রয়কেন্দ্রে নিতেও সাতক্ষীরায় সেনাবাহিনী :

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, ‘শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নটি বিচ্ছিন্ন। সেখানে ইউএনওর নেতৃত্বে সিভিল প্রশাসন কাজ করছে। কিন্তু সেখানকার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এক জন মানুষও যেন অনিরাপদ না থাকেন সে কারণেই আমরা সেনাবাহিনী চেয়েছি। ১০০ সেনা সদস্য স্থানীয় মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে সহযোগিতা করেছে। পরবর্তীতে তারা উদ্ধারকাজে অংশ নেবেন।’

প্রস্তুত সেনা সদস্য, জাহাজ হেলিকপ্টার :

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর সকল সেনানিবাস, ঘাঁটি, জাহাজ ও হেলিকপ্টার। উপকূলীয় এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিত্সা সহায়তায় খুলনা, চট্টগ্রাম ও সেন্টমার্টিনে ১০টি যুদ্ধজাহাজসহ নৌ কন্টিনজেন্ট ও মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিত্সা সহায়তায় বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরায় পাঁচটি, চট্টগ্রামে তিনটি ও সেন্টমার্টিনে দুইটি যুদ্ধজাহাজসহ নৌ কন্টিনজেন্ট ও মেডিক্যাল টিম মোতায়নের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’ ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার তত্পরতায় নৌবাহিনী তিন স্তম্ভের ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এদিকে নৌবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সেন্টমার্টিনে আটকে পড়া পর্যটকদের নিরাপদ আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। খুলনা নৌ অঞ্চল থেকে মোতায়েনকৃত জাহাজসমূহ বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহে ২ হাজার প্যাকেট জরুরি খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করবে। এছাড়া দুর্গত এলাকাগুলোতে জরুরি চিকিত্সা সহায়তার জন্য পাঁচটি বিশেষ মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিনামূল্যে চিকিত্সাসেবা, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও খাবার স্যালাইন বিতরণের কাজে নিয়োজিত থাকবে। পাশাপাশি চারটি নৌ কন্টিনজেন্ট যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে।