শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বার্লিন প্রাচীর পতনের তিন দশক

আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ২২:২২

৯ নভেম্বর বার্লিন প্রাচীর পতনের তিন দশক পূর্ণ হইয়াছে। ১৯৮৯ সালের এই দিনে জার্মানির বার্লিন শহরকে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের নামে কয়েক দশক ধরিয়া প্রাচীর তুলিয়া পূর্বে ও পশ্চিমে বিভক্ত করিয়া রাখিবার ব্যবস্থাটির অবসান হয়। সমাজতন্ত্রের কথা বলিয়া মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহীন আমলাতান্ত্রিক একটি একনায়কি ব্যবস্থার অধীন হইতে পূর্ব জার্মানি এই দিনটিতে মুক্ত হইয়া যায়। পূর্ব বার্লিনে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নামিয়া হাতুড়ি-শাবল হাতে লইয়া আক্ষরিক অর্থেই বার্লিন প্রাচীর গুঁড়াইয়া দেয়। বহুদিন ধরিয়া পূর্বে-পশ্চিমে বিভক্ত হইয়া থাকা জার্মান জাতির একাত্ম হইবার সেই আবেগঘন দৃশ্য টেলিভিশনযোগে সারা পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়ে। বার্লিন প্রাচীর পতনের  বেশ কিছুদিন পূর্ব হইতেই তত্কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া, ইউক্রেনসহ অন্য কয়েকটি অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হইয়াছিল। কোনো কোনো স্থানে জোরজবরদস্তি করিয়াও সমাজতন্ত্রের নামে একনায়কি ব্যবস্থাটি টিকাইয়া রাখিতে বেগ পাইতে হইতেছিল। এতত্সত্ত্বেও অধিকাংশ বিশ্লেষক একমত যে, বার্লিন প্রাচীরের পতনই মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের উপরে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আঘাতটি হানিয়া দেয়। স্মরণ করা যাইতে পারে যে, ইহার মাত্র দুই বত্সরের মাথাতেই সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন হয়।

রাষ্ট্রিক সমাজতন্ত্রের পতনের পর হইতেই গণতান্ত্রিক শিবিরটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিতে থাকে। ফ্রান্সিস ফুকোয়ামার মতো আমেরিকান পণ্ডিতেরা দারুণ উদ্বেলিত হইয়া এমনকি ‘ইতিহাসের সমাপ্তি তত্ত্ব’ও দিয়া ফেলেন। এই তত্ত্বমতে, সমাজতন্ত্রের পতনের পরে গণতন্ত্র তথা পুঁজিবাদ হইতেছে মানবজাতির একমাত্র মতাদর্শ। বার্লিন প্রাচীর পতনের তিন দশকের মাথায় এই বক্তব্যকে প্রশ্ন করিবার মতো অনেক কারণ উপস্থিত হইয়াছে বলিয়া অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। গত তিন দশকে বিশ্ববাসী কি প্রত্যক্ষ করিতেছে?

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে আমেরিকা সর্ব অর্থে পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তিতে পরিণত হইয়াছে; কিন্তু এই দেশটি গণতান্ত্রিক বিশ্বের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করিতে পারিতেছে কি? দীর্ঘকাল ধরিয়া বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার কারণ হইয়া থাকা সমস্যাগুলির কোনো সমাধান হইতেছে কি? এইক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কিংবা কোরিয়া উপদ্বীপের উত্তেজনার কথা সামনে আসিবে। বেশ কয়েক বত্সর ধরিয়া চলমান সিরিয়া সমস্যার কথাই বা কী বলা যাইবে? আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানগুলির বৈশ্বিক গণতন্ত্রের জন্য কতখানি ইতিবাচক হইয়াছে? গত তিন দশকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নব্য-উদারনীতিবাদের প্রকোপে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পদের ব্যাপক বৃদ্ধি দেখা গেলেও, বৈষম্য বাড়িতেছে ততোধিক। এই বৃদ্ধি এতটাই প্রকট হইয়াছে যে, দেশে দেশে মানুষ গণতন্ত্রের অনেকগুলি খুঁটি ধরিয়া টান মারিতেও দ্বিধা করিতেছে না। অনেক প্রভাবশালী দেশে গণতন্ত্রের চাদর পরিয়া গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠান হইয়া আছে। গণতন্ত্রের নামে নৈরাজ্য আসিয়া সমাজতন্ত্রের নাম করিয়া থাকা স্বৈরাচারের স্থলটি দখল করিয়া লইয়াছে কি না তাহাই এখন বড়ো একটি জিজ্ঞাস্য হইয়া উঠিয়াছে।