বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মহানবি মুহাম্মদ (স)-এর বিশ্বস্ততা

আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ২০:৪৬

মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে বিশ্বস্ততা। বিশ্বস্ততা অর্জন ছাড়া একজন মানুষ কখনো খাঁটি মুমিন হতে পারে না। মুসনাদে আহমাদের এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত আনাস (রা) সূত্রে বর্ণিত, নবি পাক (স) বলেন, ‘যার মধ্যে বিশ্বস্ততা নেই, তার কোনো ইমান নেই, আর যার মধ্যে অঙ্গীকার রক্ষার গুণ নেই, তার মধ্যে ইসলাম নেই।’

অসত্ ব্যক্তিদের সঙ্গ ত্যাগ করে আল্লাহ তার বান্দাকে বিশ্বস্ত মানুষের সঙ্গী হতে বলেছেন। সুরা তওবার ১১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্-স্বচ্ছবাদী বিশ্বস্ত মানুষের সঙ্গী হও।’ জগতে সততা ও বিশ্বস্ততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন আমাদের রাসুলে পাক (স)। তার কর্মবহুল জীবনে আমরা বিশ্বস্ততার অপূর্ব মহিমা দেখতে পাই। রাসুলে পাক (স) যুবক বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ সংগঠন গড়ে তুলে তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মক্কার সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা আমাদের সর্বকালে, সব মানুষের জন্য অনুসরণীয় হয়ে আছে। নবুওয়াত লাভের পর যখন মক্কার কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ (স)-এর চরম শত্রু হয়ে উঠেছিল, তখনো তারা তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র রাসুল (স)-এর কাছে আমানত রাখত। মক্কার কাফের-মুশরিকদের জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে নবিজি যখন মদিনায় হিযরত করেন, তখনো তার কাছে বিধর্মীদের কিছু জিনিসপত্র আমানত ছিল। তিনি তা ফেরত দেওয়ার জন্য হযরত আলী (রা)কে মক্কায় রেখে গিয়েছিলেন।

জীবনের সংকাটাপন্ন অবস্থায়ও মানুষের আমানত খেয়ানত করা যাবে না এবং যত প্রতিকূল অবস্থা আসুক না কেন, বিশ্বাসও ভঙ্গ করা যাবে না, এটা হচ্ছে নবিজির শিক্ষা। আমাদের নবি বিশ্বনবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স) সততা ও বিশ্বস্ততা কীভাবে রক্ষা করেছেন, তার আরেকটি নমুনা হলো গজওয়ায়ে আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধ। রাসুলে পাক (স) মক্কা থেকে যখন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে মদিনায় হিযরত করে গেলেন, তখন সেখানে তিনি নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন। ইসলামের শত্রু হিসেবে কাফের-মুশরিকদের সঙ্গে মদিনার ইয়াহুদিরাও যোগ দিল। তারা একজোট হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। এমতাবস্থায় বিশ্বনবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স) শত্রুর মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মদিনার প্রবেশদ্বারে সাহাবিদের নিয়ে তিনি পরিখা খনন করতে লাগলেন। এ সময় মুসলিম সৈন্যরা চরম খাদ্য-সংকটের সম্মুখীন হন। এক ইয়াহুদি যুবক ইসলামের সুমহান আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের খাদ্য-সংকটের কথা চিন্তা করে নবিজির দরবারে আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মালিক একজন ইয়াহুদি, আমি তার অনেক ভেড়া লালন-পালন করি। আমার কাছে অনেকগুলো ভেড়া রয়েছে, আপনি অনুমতি দিলে এই ভেড়াগুলো এনে ক্ষুধার্ত মুসলিম সৈন্যদের দিয়ে দিতে পারি। তারা জবাই করে এর দ্বারা ক্ষুধা নিবারণ করবেন। নবিজি তার কথা শুনে শত শত ক্ষুধার্ত মুসলিম সৈন্যের উপস্থিতিতে বললেন, জেনে রেখো, ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বাসঘাতকতা সবচেয়ে বড়ো অপরাধ। ভেড়াগুলো তোমার নয়। যদিও ইয়াহুদিরা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তবু আমরা তাদের গৃহপালিত পশুগুলো নেব না। আমি চাই, তুমি এখনই ভেড়াগুলো নিয়ে ইয়াহুদিদের দুর্গে ফিরে যাও এবং সেগুলো অক্ষত অবস্থায় তোমার মালিককে ফিরিয়ে দাও। তুমি যদি সত্যিকারের মুসলমান হতে চাও, তাহলে আমার এ নির্দেশ পালন করো।

এই ছিল মহানবি মুহাম্মদ (স)-এর বিশ্বস্ততার নজির। তিনি শুধু কথার মাধ্যমে নয়, কাজের মাধ্যমেও উম্মতকে বিশ্বস্ততার প্রতি উত্সাহ জুগিয়েছেন। মহানবি (স)-এর আমানতদারি ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে আরবের কাফের-মুশরিকরা তাকে আল-আমিন, অর্থাত্ সত্যবাদী উপাধি দিয়েছিল। আরবের বুকে তারা এমন বিশ্বস্ত লোক আর কোনো দিন দেখেনি। তাই আমাদের সর্বাবস্থায় আমানতদারি রক্ষা করে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য একেকজন রক্ষক। বুখারি ও মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলে কারিম (স) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের সবাই দায়িত্বশীল, সবাইকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। শাসনকর্তা রাষ্ট্রের সব ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার ঘরে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। নারী তার স্বামীর গৃহে দায়িত্বশীল, স্বামীর ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। সেবক তার কর্তার সম্পদে দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। অতএব, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। সবাইকে তার নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।’

আজ যত ধরনের দুর্নীতি, খেয়ানত ও অর্থ আত্মসাত্ হচ্ছে, তা মূলত বিশ্বস্ততার অভাবেই হচ্ছে। আল্লাহর পরিপূর্ণ ভয় যদি আমাদের অন্তরে থাকত, বিশ্বস্ততা অর্জনের যে শিক্ষা রাসুলে পাক (স) আমাদের দিয়ে গেছেন, তা যদি আমরা অর্জন করতে পারতাম, তাহলে আমাদের এই নৈতিক অধঃপতন হতো না। তাই আসুন, আমরা ইসলামের সুমহান আদর্শ বিশ্বস্ততার গুণে গুণান্বিত হই এবং প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মানসিকতা গড়ে তুলি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন!

লেখক :ধর্মীয় আলোচক ও উপস্থাপক এবং খতিব,

জাজিরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন