শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সাত নম্বর বিপত্সংকেত

আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০১৯, ২২:০১

ক্রমশ: শক্তি বাড়িয়ে অতি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ধেয়ে আসছে ’বুলবুল’। আজ শনিবার রাতের যে কোন সময় বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চলে আছড়ে পড়বে এটি। প্রতি মুহুর্তে শক্তি সঞ্চয় করে বুলবুল সুন্দরবন উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান গতিপথ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের খুলনা-বরিশাল অঞ্চলে আঘাত হানার আশংকা রয়েছে বলে জানান আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। আবহাওয়া দফতর গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় বিশেষ বুলেটিনে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দিয়েছে। চট্রগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ৬ এবং কক্সবাজারে ৪ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলবর্তী জেলা ও অদূরবর্তীদ্বীপ ও চরসমুহকে ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া দফতর। বঙ্গোপসাগরে বুলবুলের ঘূর্ণনের গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার। সন্ধ্যায় বাংলাদেশের খেপুপাড়া থেকে ঘূর্ণিঝড় অবস্থান করছিল ৫৫০ কিলোমিটার দূরে।  বুলবুলের প্রভাবে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, চট্রগ্রাম, কক্সবাজারসহ সারাদেশে গুড়িগুড়ি বৃস্টি শুরু হয়। উপকূলীয় এলাকায় বইছে দমকা হাওয়া। ১০ বছর পর এই প্রথম কোনও ঘূর্ণিঝড়ের বাংলাদেশ উপকূলে আছড়ে পড়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতেই গভীর নিম্নচাপ থেকে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় (সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম)-এ পরিণত হয় ‘বুলবুল’। এখন সেটি ‘ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা অতি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে বলে জানান আবহাওয়াবিদরা। তারা বলছেন, বুলবুল ছোবল দেয়ার সময় যদি সাগরে জোয়ার থাকে তবে প্রলংকারী হয়ে উঠতে পারে। আর ভাটা থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’র বলয়ে  থাকা সাত জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। জেলাগুলো হলো- খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও ভোলা। ‘বুলবুল’ মোকাবেলায় ২২টি  মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে সরকার।

গতকাল বিকালে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড.এনামুর রহমান বলেন, আজ শনিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত যে কোনো সময় ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আঘাত হানতে পারে। তাই এর মোকাবেলায় সরকার সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকার জনগণকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৫ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। উপকূলবর্তী সব জেলা ও উপজেলায় প্রায় ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। প্রত্যেক জেলায় নগদ পাঁচ লাখ টাকা করে আগাম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে আশ্রয় নিতে মাইকিং করা হচ্ছে।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যার পর সদরঘাট টার্মিনাল থেকে সব ধরণের নৌ-যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটেও সব ধরণের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু সরকার জানান, পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটের সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে। এদিকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সেন্টমার্টিনে আটকা পড়েছেন ১২ শত পর্যটক। দুবলার চরে আগামী ১০ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া রাসমেলা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাসমেলা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বসু শন্তু এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। একই সঙ্গে ‘বুলবুলের’ কারণে সুন্দরবনে পর্যটকদের প্রবেশও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, বঙ্গোপসাগরে যেসব ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়, উপকূলে আঘাত করার আগে সাধারণত সেগুলোর শক্তি বৃদ্ধি পায়। আবার কখনও কখনও দুর্বল হওয়ার নজিরও রয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী,ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার, যেটি দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নাম কেন ‘বুলবুল’?

ভয়ঙ্কর ঝড়, অথচ এমন ফুরফুরে নাম কেন?  বুলবুল এর নামকরণ করেছেন পাকিস্তানের আবহাওয়াবিদরা। বুলবুল অর্থ সুকণ্ঠ গানের পাখি। বুলবুলের পাশাপাশি গুজরাট উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ‘সাইক্লোন মহা’। তার আগে ‘ফণী’, অথবা ‘বায়ু’, অথবা ‘তিতলি’ চলে গেছে। বহু বছর আগেই স্থির করা হয়, সংখ্যা বা পরিভাষার চেয়ে যেহেতু নাম মনে রাখা সহজ, সেহেতু নামকরণ করা হবে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের। এতে যেমন জনসচেতনতা বাড়াতে সুবিধে হয়, তেমনই মিডিয়ার সুবিধে হয় ঝড় নিয়ে লিখতে। তথ্যে দেখা যায়, এই প্রথা প্রথম চালু হয় অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে। যেসব ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩৯ মাইল ছাড়িয়ে যেত, তাদের বিশেষ সম্মান জানাতে নামকরণ করা হতো। ঘণ্টায় হাওয়ার গতিবেগ ৭৪ মাইল ছাড়িয়ে গেলে হারিকেন, সাইক্লোন বা টাইফুন হিসেবে ভাগ করা হতো। বর্তমান যুগে এই তিনটির একটি হলে তবেই কোনও ঝড়কে নামকরণের সম্মান প্রদান করা হয়। আজকের দিনে ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের আনুষ্ঠানিক নামকরণ করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের আওতায় এগারোটি সতর্কতা কেন্দ্রের যে কোনও একটি। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সব নাম জমা পড়ে এই সংস্থার আঞ্চলিক ট্রপিক্যাল সাইক্লোন কমিটির কাছে। একবার নাম চূড়ান্ত হয়ে গেলে তা বদল করা যায় না, যদি না ঝড়ের ফলে খুব বেশি মাত্রায় মৃত্যু অথবা সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। যেমন ধরুন, ‘ফণী’ নাম রেখেছিল  বাংলাদেশ। এই নামকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করে দিল্লির রিজিওনাল স্পেশালাইজড মিটিওরোলজিকাল কেন্দ্র। ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে ঝড়ের নামের তালিকায় ‘বুলবুল’-এর পরে আসছে ‘পবন’।

এদিকে ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশন একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে যার দ্বারা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নামের তালিকা গ্রহণ করে তারা। প্রয়োজন মতো এই সমস্ত তালিকা থেকে বেছে নেওয়া হয় নাম। ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে উদ্ভূত ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের নামের তালিকা আঞ্চলিক কমিটির কাছে পাঠায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, এবং থাইল্যান্ড। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এই আটটি দেশের তরফে আটটি করে সাইক্লোনের নাম জমা দেওয়া হয়। এই ৬৪টি নামের তালিকা থেকেই বেছে নেওয়া হয় ‘ফণী’, ‘তিতলি’ বা ‘আইলা’। বর্তমানে এই তালিকার শেষ স্তম্ভ থেকে নাম বাছা হচ্ছে, ফলে এই অঞ্চলে পরবর্তী সাইক্লোনের নাম হতে চলেছে ‘পবন’।  নাম প্রস্তাব করেছে শ্রীলঙ্কা।