রাজনীতিতে সব উদ্যোগের পক্ষে এবং বিপক্ষে মতবাদ সৃষ্টি হয়। রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ সমর্থন বলে কিছু নেই। কিন্তু বাকশালকে নিয়ে একটা শ্রেণি, ১৯৭৫- এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে টানা দুই দশকের বেশি সময় ধরে যেসব প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে, তা কোনো রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়। টার্গেট করে তারা প্রথমে জনমনে ঘৃণা ছড়ানোর এজেন্ডা সেট করেছে, এরপর সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দুই দশক ধরে প্রচারণা চালিয়েছে। তাদের দমনপীড়নের মুখে আর কেউ প্রতিবাদ করার সাহসটিও পায়নি।
মূলত, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো সহ্য করতে না পেরে বাকশালবিদ্বেষ ছড়িয়েছে। যেহেতু দুটি সম্পূর্ণ প্রজন্ম একটি প্রোপাগান্ডা শুনে শুনে বড় হয়েছে, তাই বাকশাল নিয়ে অপপ্রচার চালানোটা এখন আরো সহজ হয়ে গিয়েছে।
বাকশাল নিয়ে যারা নেতিবাচক আক্রমণ করেন, তাদের মধ্যে তিন শ্রেণির মানুষ আছে।
এক, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগসহ প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী গোষ্ঠী, ৭১ এ বর্বর ভূমিকার জন্য বঙ্গবন্ধু এই দেশের মাটিতে যাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন।
দুই, ক্ষমতালিপ্সু ও উগ্র-বামপন্থী গোষ্ঠী।
তিন, সরলপ্রাণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তারা বাকশালের বিরোধিতা করলেও, তাদের মন্তব্য অভিন্ন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারা সবাই জোর প্রচারণা চালায় এই বলে যে, বাকশাল মানে গণতন্ত্রের মৃত্যু। স্বাধীনতাবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী ও উগ্রবামদের উপর্যুপুরি নেতিবাচক প্রচারণার ফলে তাদের মনে এই ধারণা প্রোথিত হয়। অথচ তারা বাকশাল সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে পারে না।
প্রথম ও দ্বিতীয় দলের মানুষদের ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নাই, এটি তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা। তবে তৃতীয় দলটির উচিত নিজেরা বাকশাল ও বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কে অধ্যয়ন করা। তাহলেই বাস্তবতা পরিষ্কার হয়ে যাবে তাদের কাছে।
বাকশালে কারা ছিল, কারা ছিল না:
মূলত, বাকশাল হলো একটি কনসেপ্ট, যার বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয়েছিল বহুদলের সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। আওয়ামী লীগ এই প্লাটফর্মের প্রধান দল হলেও, মূলধারার অন্যদলের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), এছাড়াও ছোট ছোট আরও বেশ কয়েকটি দল বাকশালের অর্ন্তভুক্ত হয়।
মোট কথা, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যেসব দল উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিল, মূলত সেসব দল নিয়েই গঠিত হয় বাকশাল।
অন্যান্য দল- যেমন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (যার জন্ম স্বাধীনতার পর, যারা বিপ্লবের নামে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছিলো দেশের ভেতর), পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (তখন আন্ডার-গ্রাউন্ডে থেকে নাশকতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত), শুধু এদের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। আর নেওয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ও যুদ্ধরত বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত উগ্রবাদী দলগুলোকে। কারণ, স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম নিষিদ্ধ হয় ১৯৭১-এ তাদের ভূমিকার জন্য।
জনগণকেন্দ্রিক গণমুখী একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে, অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করাই ছিল বাকশালের প্রধান উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ‘এটা অস্থায়ী (ব্যবস্থা), সময় এলে এটা সরিয়ে নেওয়া হবে’। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, দেশ গড়ার কাজে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়ে, দ্রুত দেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ প্রয়োজনে প্রবর্তিত হয়েছিল বাকশাল।
দেশের ভিতরের প্রতি বিল্পবী এবং সশস্ত্র দেশদ্রোহীদের প্রতিহত করে, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করে এবং সেই সাথে বহির্বিশ্বের উপনিবেশিক শক্তিকে সামলিয়ে, সর্বস্তরে স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভই ছিল বঙ্গবন্ধুর বাকশালের অন্যতম উদ্দেশ্য।