শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনার প্রকোপে নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দুর্বিষহ জীবন

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২০, ২১:০৫

করেনা ভাইরাসের কারণে নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। স্কুল বন্ধ থাকায় বাসায় সন্তান লালন-পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন বহু অভিভাবক। কীভাবে সন্তানের ভরণপোষণ করবেন সে চিন্তা ভাবিয়ে তুলেছে তাদের। স্কুল ডে’তে সন্তান স্কুলে যেত, সারা দিন তাদের কাটতো স্কুলেই, টিফিন খেত স্কুলের। কিন্তু এখন সময় কাটছে তাদের বাসায়। ফলে সন্তানের চাহিদা মেটাতে গিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষেরা চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। 

এদিকে রবিবার রাত ৮টা থেকে কার্যকর হচ্ছে নিউইয়র্ক রাজ্য লকডাউনের ঘোষণা। অন্যদিকে সব নাগরিককে দুই সপ্তাহের জন্য বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে দিন কাটাতে হবে সবাইকে। এ অবস্থায় স্বল্প আয়ের প্রবাসীরা আরো করুণ পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারেন। 

নিউইয়র্কের জ্যামাইকার সাটফিন বুলেভার্ডের বাসিন্দা মাসুদ আহমেদ জানান, গত ১৩ বছর ধরে  তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে বাসার পাশে স্কুলে পড়ে। স্ত্রী সপ্তাহে চারদিন ডানকিন ডোনাটসে কাজ করেন। আর তিনি কাজ করেন ম্যানহাটনের একটি রেস্টুরেন্টে। দুই বাচ্চাকে স্কুলে থাকার সুবাদে তারা নির্বিঘ্নে কাজ করতেন। এখন করোনা ভাইরাসের কারণে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। এমনকী তাদের দুজনের কর্মঘণ্টা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। আয়ও কমে যাবে অর্ধেকে। মাস শেষে কীভাবে ঘর ভাড়া দেবেন, সন্তানের খাবার জোগাড় করবেন সে চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তারা। 

মাসুদ শরীফ জানান, হাতে যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে এক মাসের বাজার কিনে রেখেছি। কিন্তু দু’সন্তান বাসায় থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে খাবার কেনা যায়নি। মেয়ের বয়স ১১ এবং ছেলের ৭। ছোট ছেলে-মেয়ে তারা। বাসায় থাকায় কিছুক্ষণ পরপরই তারা বায়না ধরছে এটা সেটা খাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা তাদের বাড়তি খাবার দিতে পারছি না।

আরো পড়ুন: করোনা আতঙ্কের মধ্যেও পেছাবে না বাফুফে নির্বাচন

তিনি বলেন, এ অবস্থা বেশীদিন চললে মনে হয় আমরা বাঁচতে পারবো না। আয় যদি না থাকে, ব্যয় করবো কোত্থেকে? কী যে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও নিউইয়র্কের পাঁচ বরোতে কমপক্ষে আড়াই লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকায় মাসুদ আহমেদের মত হাজারো পরিবারে যেন দুর্দিন নেমে এসেছে। প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে জীবন দুর্বিষহের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে। কমে আসছে সরবরাহ। এসব চিন্তায় দিশেহারা পরিবারগুলো। 

জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি মালিকানাধীন এক রেস্টুরেন্টের মালিক জানান, সিটির নির্দেশের পর তারা শুধু টেকব আউট সার্ভিস চালু রেখেছেন। ফলে বিক্রি রাতারাতি অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। উপায় নেই, তাই কর্মচারীদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিয়েছি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অনেককে না করে দিতে হবে। এ কাজটি করতে খারাপ লাগবে। কিন্তু কিছুই করার নেই। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার জানান, গত ৬ বছর ধরে তিনি কাজ করছেন। এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখে তাকে পড়তে হয়নি। তিনি বলেন, এখানে যারা কাজ করে তাদের অনেকেই স্টুডেন্ট। কিন্তু ঘরভাড়া নিজেদের দিতে হয়। কাজ না থাকলে তারা চলবে কী করে? সরকার থেকে তারা সাহায্যও পাবে না। 

এস্টোরিয়ার স্টাইনওয়ের বাংলাদেশি একটি রেস্টুরেন্টের মালিক জানান, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর তাদের ব্যবসা চরম মন্দা যাচ্ছে। টেক আউট সার্ভিসে তাদের রেস্টুরেন্টের ভাড়ার টাকাও উঠবে না। ইতিমধ্যে কর্মচারীর সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে এনেছেন। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে রেস্টুরেন্টে তালা ঝুলাতে হবে। 
এদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে দ্রুত আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন নিউইয়র্কের ক্যাবিরা। আর্থিক সঙ্কটের কারণে চরম হতাশার মধ্য জীবন-যাপন করছেন তারা। করোনা ভাইরাসের কারণে সিটি লকডাউন হলে তারা পুরোপুরি কর্মহীন হয়ে পড়বেন। লকডাউন যদি নাও হয়, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে তাদের গাড়ি চালানোও সম্ভব হবে না। আর গাড়ি না চালালে সংসার চলবে না। 

নিউইয়র্ক শহরে হলুদ ট্যাক্সির সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। অ্যাপভিত্তিক গাড়ির সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশী। এছাড়াও আছে গ্রিণক্যাব। সবমিলিয়ে ৯০ হাজার ক্যাবি রয়েছে নিউইয়র্কে। এই ৯০ হাজার ক্যাবির মধ্যে বাংলাদেশি ক্যাবি প্রায় ৩০ হাজার। করোনাভাইরাস তাদের জীবনে অভিশাপ হিসাবে দেখা দিয়েছে। 

উডসাইডে বসবাসরত একজন বাংলাদেশি ক্যাবি জানান, গত দুসপ্তাহ ধরে তিনি গাড়ি চালাতে পারছেন না। গাড়ি নিয়ে বের হলেও রাস্তায় যাত্রী পাচ্ছেন না। আট ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ১০০ ডলার আয় হয় না। গাড়ির জমা টাকা ওঠে না। 

তিনি বলেন, বাসায় তার তিনটি বাচ্চা। তাদের স্কুল বন্ধ। কীভাবে তাদের আহার জোগাড় করবেন তা মাথায় আসছে না। একদিকে আয় রোজগারের চিন্তা, অন্যদিকে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক, দু-ই যেন তাদের গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। তিনি জানান, বাচ্চারা স্কুল খোলা থাকলে তাদের নিয়ে কিছুটা চিন্তামুক্ত থাকতাম। কিন্তু এই আতঙ্কের মধ্যে স্কুল বন্ধ না দিয়েও তো কোনো উপায় ছিল না। কী যে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। 

উল্লেখ্য, স্টুডেন্টদের করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ বেশ কয়েকটি স্টেটের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে বাসা থেকে যাতে স্টুডেন্টরা হোম ওয়ার্ক করতে পারে ও অনলাইনে এ সময়ের লেখাপড়া সম্পন্ন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ালেখায় যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য এই বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য ইতিমধ্যে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছে।

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ইমেইল বার্তা পাঠানো হয়েছে। যারা ইউনিভারসিটিতে স্টুডেন্ট ওয়ার্কার হিসাবে কাজ করতো তাদেরকেও কাজে যাওয়ার জন্য নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তাদেরকে বাসায় থাকার জন্য ও জনসমাগম হয় তেমন জায়গায় না যাওয়ার জন্য।

ইত্তেফাক/এএএম