বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নিউইয়র্কে করোনায় মারা গেলেন পিরোজপুরের আইনজীবী

‘বাবাকে হারিয়ে কাঁদতেও পারছি না’

আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২০, ১২:০১

বৈশ্বিক মহামারীতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (এনওয়াইপিডি) ডিটেকটিভ জামিল সারোয়ার জনির শরীরে ঢুকেছে করোনাভাইরাস। পরীক্ষায় যখন পজিটিভ ধরা পড়লো ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। ঘরে আক্রান্ত হয়েছেন তার বাবা। আর বাবাকে সেবা দিচ্ছিলেন মা। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের নেওয়ার পর স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরে বাবা অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। 

এখন মা অধ্যক্ষ রেনু সুলতানাও অসুস্থ। তার এখনো কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয়নি। বাবা যে বেঁচে নেই তা অসুস্থ মাকে জানানো হয়নি। অন্যদিকে বাবার মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদতেও পারছেন না জনি, যদি তার মা জেনে যায় এই আশঙ্কায়। সহকর্মীরা বাবার মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সন্তান হিসাবে কিছুই করতে পারছেন না ডিটেকটিভ জনি। 

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি অনেক পরিবারে করোনাভাইরাস এভাবে ভয়াল ছোবল দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে বহু বাংলাদেশির প্রাণ। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে অনেক পরিবারকে। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন অনেক বাংলাদেশি। কিন্তু জনির পরিবারের করুণ এই অসহায়ত্বের কথা শুনে তার সুহৃদসহ বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই মুষড়ে পড়েছেন। 

লম্বা ছুটি কাটিয়ে স্ত্রী ও কন্যাকে বাংলাদেশে রেখে ইমিগ্রান্ট বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় এক মাস আগে নিউইয়র্কে ফিরে কর্মস্থলে যোগ দেন ডিটেকটিভ জামিল সারোয়ার জনি। নিউইয়র্ক পুলিশের ‘হিরো’ উপাধি পাওয়া জনি বর্তমানে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ে কর্মরত। পেশাগত কারণে সাদা পোশাকে (আন্ডারকভার) অনেক জায়গায় যেতে হয় তাকে। পুরো নিউইয়র্ক যখন লকডাউন তখনো দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। হঠাৎ একদিন বাসায় ফিরে অসুস্থবোধ করেন জনি। গলা ব্যথা ও তীব্র জ্বরের লক্ষণ শরীরে। একদিন সকালে নিজেই গাড়ি চালিয়ে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা করিয়ে আসেন। ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসাবে দ্রুত জানতে পারেন তার শরীরে ঢুকে পড়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাস। কিন্তু শরীরের ইমিউন সিস্টেমের সঙ্গে লড়াই করে প্রায় দুসপ্তাহ পর সুস্থ হয়ে ওঠেন জনি।

অন্যদিকে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা সারোয়ার হোসেন। হাসপাতালে নেওয়ারও পরিবেশ নেই। শরীরে কোভিড-১৯ ধরা পড়লেও সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছিল না। বাসায় রেখেই চিকিৎসা চলছিল তার। এরইমধ্যে মঙ্গলবার দুপুরে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স কল করে সারোয়ার হোসেনকে নিয়ে যাওয়া হয় বাসার কাছের এলমহার্স্ট হাসপাতালে। এই হাসপাতালটি এখন অনেকটা মৃত্যুপুরী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। নিউইয়র্ক সিটিতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড এই হাসপাতালেই।  

স্থানীয় সময় দুপুর দেড়টায় হাসপাতালে মারা যান ডিটেকটিভ জনির বাবা অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন। তার মরদেহ এখনো হাসপাতালে অস্থায়ী হিমঘরে রয়েছে। মরদেহ বুঝে পেলে ফিউনারেল হোমের সহযোগিতায় মরদেহ দাফন করা হবে লং আইল্যান্ডের ওয়াশিংটর মেমোরিয়াল মুসলিম কবরস্থানে। আইন অনুযায়ী ৫-৭ জন অংশ নিতে পারবেন জানাজায় এবং দাফন কার্যক্রমে। 
ডিটেকটিভ জনি জানান, তার মা আগের চেয়ে এখন কিছুটা সুস্থ। তিনি হাসপাতালেও যেতে চাচ্ছেন না। তিনি বলেন, বাবাকে হারিয়ে কাঁদতেও পারছি না, যদি মা জেনে যান এই আশঙ্কায়। তাহলে হয়তো মাকেও হারাতে হতে পারে।’ 

জনির বড় ভাই শাকিল সারোয়ার রনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) জাতীয় ক্রিকেট দলের প্যানেল মেডিকেল অফিসার। ঢাকা থেকে টেলিফোনে তিনি জানান, বাবা-মাকে মাত্র কিছুদিন আগে হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদায় জানালাম। কয়েকদিনের ব্যবধানে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে শেষবারের মত বাবার মুখটিও দেখতে পারছি না। ভিসা থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রে যাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে যেতে পারলেও বাবাকে দেখতে পারবো না। রনি বলেন, আমি তো চিৎকার করে কাঁদতে পারি। কিন্তু আমার ছোট ভাই জনি তো কাঁদতেও পারছে না। ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাবাকে হারিয়ে মায়ের জন্যও খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। 

ডিটেকটিভ জনির সহকর্মী নিউইয়র্ক পুলিশের অফিসার আব্দুল লতিফ জানান, এলমহার্স্ট হাসপাতালে শুধু লাশ আর লাশ। কখন জনির বাবার মরদেহ বুঝে পাব জানি না। মরদেহ পাবার পর দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, জনির বাবার মৃত্যুতে আমরা সহকর্মীরা গভীরভাবে শোকাহত।  

অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন পিরোজপুর শহরের সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন। তার সহধর্মিণী রেনু সুলতানা পিরোজপুর সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ছোট ছেলে জনির আবেদনে তারা যুক্তরাষ্ট্রে ইমিগ্র্যান্ট হয়েছেন। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে তারা আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। 

উল্লেখ্য, নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আক্রান্ত হাজার হাজার। কিন্তু আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার কোনো হিসাব নেই কারো কাছেই। 

ইত্তেফাক/এমআর