সৃজন মানে সৃষ্টি। সৃষ্টি মানে নতুন কিছু তৈরি করা,পথ নির্দেশ করা,লক্ষ্য ঠিক করা।ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছা। একটা চিন্তার উপর ভর করে অপেক্ষাকৃত ভালো কিছু করা। কিন্তু কীভাবে করবে ? মাথা খাটিয়ে । মাথায় কোথা থেকে চিন্তার যোগান আসবে ? বই পড়া থেকে।বই হল মই, অর্থাত্ ওপরে ওঠার সিঁড়ি।বইয়ের কালো হরফে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য,সভ্যতা,সংস্কৃতি,সমাজ, নৃতত্ত্ব, প্রকৃতির নানা উপাদানের কথা যা সমৃদ্ধ করে মানুষকে।
পৃথিবীর পথিক হিসেবে ঘুরে বেরিয়ে অর্থাত্ ভ্রমন করেও সৃজনশীল বিকাশ ঘটানো সম্ভব।দেখে শেখার কাজটি ভ্রমনের মাধ্যমে করেও নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে পারে। শুনে শেখা ও করে শেখার ভিতর দিয়েও স্বপ্নের পথ বিনির্মাণ করা সম্ভব।মুখস্থ নিভর্র শিক্ষা অনেকটা কূপের ব্যাঙ্গের মত।ছোট্ট একটি জায়গায় নেচে গেয়ে থাকা মনে মনে ভাবা এটাই সমুদ্র। সমুদ্র যে কত বিশাল বিস্তৃত তা তো সে দেখেনি। কূপের সোজা ওপরে তাকিয়ে আকাশের খণ্ড রূপকে দেখে ।পুরো আকাশ দেখেনি।স্বপ্ন আঁঁকার সাধও এখানেই শেষ। অর্থাত্ ছোট্ট পরিসরে আকাশের বিশালতা, সমুদ্রের গভীরতা উপলদ্ধি করার জন্য মুক্ত অঙ্গনে আসতে হবে। পৃথিবীর পাঠশালায় ভর্তি হতে হবে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা লাভ করতে হবে। চিন্তা,বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটানোর পথ প্রশস্ত করতে হবে। ছোট্ট শিশুটিকে অথবা ক্ষুদে শিক্ষার্থীকে উজ্জ্বল সম্ভবনাময় আগামী তৈরি করার জন্য, আত্ববিশাসী ও চিন্তাশক্তি সম্পন্ন করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বেঞ্জামিন ব্লুম তাঁর ভাবনাকে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃত মানুষ তৈরি হওয়ার জন্য তিনটি ক্ষেত্রকে বিশেষ ভাবে বিবেচনায় এনেছেন।এগুলো হল-মননশীলতার ক্ষেত্র,আবেগীয় ক্ষেত্র, মনোপেশিজ ক্ষেত্র।
তাঁর মতে তিনটি ডোমেইন বা ক্ষেত্রের সমন্বয় ব্যতিত শিক্ষার্থীর বিকাশ কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরির ক্ষেত্রে মননশীলতারক্ষেত্র বা পড়মহধঃরাব ফড়সধরহ- এর ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তবে উদাহরণ, উপমা, অনুভূতি, প্রকাশ, প্রয়োগের ক্ষেত্র সৃষ্টি করার সময় অবশ্যিই আবেগিক ও মনোপেশিজ ক্ষেত্র কাজে লাগাতে হবে।
পুরো আলোচনা থেকে এটাই উঠে এসেছে, যে সকল প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃষ্টিশীল করে তোলা যায় তা-ই সৃজনশীল প্রশ্ন। এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে বইয়ের ভেতরে ও বাইরে । হাট, মাঠ, ঘাট থেকে, তৃণমূল থেকে,পান্তা ভাতের পাতিল থেকে কাঁচা মরিচের ভর্তা থেকে,শুঁটকির তরকারি থেকে। বাস্তব জ্ঞানের সাথে বইয়ের লেখার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা জীবনের পথ চলায় প্রয়োগ করতে সুবিধা হবে। ব্লুমস তাঁর ঞবীড়হড়সুতে জ্ঞানের ক্ষেত্র বা মননশীল ক্ষেত্রকে ০৬টি ভাগে ভাগ করেছেন। তা হল- জ্ঞান,অনুধাবন,প্রয়োগ,বিশ্লেষণ,সংশ্লেষণ,মূল্যায়ন। কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মননশীল ক্ষেত্রকে ৪টি স্তরে ভাগ করেছেন।তা হচ্ছে-জ্ঞান, অনুধাবন,প্রয়োগ ওউচ্চতর চিন্তন দক্ষতা। জ্ঞান,অনুধাবন ও প্রয়োগ এ তিনটি আলাদা আলাদা স্তর। বিশ্লেষণ,সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ন এ তিনটি মিলে একটি স্তর উচ্চতর চিন্তন দক্ষতার স্তর। এখানে বলা হচ্ছে, যে শিক্ষার্থী কোনো একটি বিষয় বা বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করতে পারবে, সামগ্রিক রূপ দিতে পারবে এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবে। ধরে নিতে হবে শিক্ষার্থীটির সৃজনশীল বিকাশ ঘটেছে। শিক্ষার্থীটি চিন্তন দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভাবকে ভাষায় তুলে এনে যথাযথ ভাবে কর্মে প্রয়োগ করতে পারবে। এই চারটি স্তরের উত্তর শিক্ষার্থীরা স্মৃতিশক্তি ও মাথা খাটানোর মাধ্যমে দিতে পারবে। তবে আমি শিক্ষার্থীদের সহজে বোঝার জন্য জ্ঞানের নাম দিয়েছি জানা, অনুধাবনের নাম দিয়েছি বোঝা, প্রয়োগের নাম দিয়েছি বোঝাতে পারা এবং উচ্চতর চিন্তন দক্ষতার নাম দিয়েছি নতুন কিছু সৃষ্টি করা।
আপনারা জানেন প্রশ্নপত্রে প্রতিটি সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্ধ থাকে। প্রথম স্তরের নাম জ্ঞানের স্তর। এ স্তরের জন্য নম্বর বরাদ্ধ থাকে এক। এ প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে একটি শব্দ থেকে তিনটি বাক্যের মধ্যে। এখানে শিক্ষার্থীর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা যাচাই করা হয়। দ্বিতীয় স্তর হলো অনুধাবন স্তর। এই স্তরের জন্য দুই নম্বর বরাদ্ধ থাকে। এর উত্তর লিখতে হবে পাঁচটি বাক্যের মধ্যে। এ ক্ষেত্র শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের যে অংশটুকু ভালো ভাবে পড়েছে তা বোঝার বা অনুধাবন করার ক্ষমতা কতটুকু অর্জন করেছে তা-ই যাচাই করা হয়। এ দুটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পাঠ্যবই পড়তে হবে।
শিক্ষার্থীরা প্রশ্নের তৃতীয় ও চতুর্থ অংশের উত্তর দিতে হবে একটু ভিন্ন ভাবে। তা হচ্ছে উদ্দীপকের মাধ্যমে, যা আমাদের দেশের জন্য নতুন। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের পড়ার বিষয়ের সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে মিল রেখে উত্তর তৈরি করতে হবে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে উদ্দীপক কী? আমি এর নাম দিয়েছি খোলা জানালা।মনের জানালা খোলে পৃথিবীকে দেখার পথ তৈরি করতে হবে। যাতে উদ্দীপকের ভেতত দিয়ে বিষয় বস্তুকে দেখা যায়। উদ্দীপক হতে পারে ছোট্ট একটা সসগদ্যাংশ,পদ্যাংশ,গ্রাফ,চার্ট,ছবি,কোনো ঘটনা, সংবাদ যার বক্তব্যের সাথে ঐ প্রশ্নের কোথাও না কোথাও এক বা একাধিক অনুভূতি বা চিন্তার মিল আছে। প্রশ্নের তৃতীয় স্তরের নাম প্রয়োগ স্তর। প্রয়োগ স্তরের জন্য বরাদ্ধ তিন নম্বর। এই প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে বারোটি বাক্যের মধ্যে। এখানে শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের ভেতর থেকে সে যে সব চিন্তাভাবনা আহরণ করেছে বাইরের ভিন্ন পরিবেশে ও ভিন্ন বিষয়ের ভিতর সে গুলোকে সে প্রয়োগ করতে পারছে কিনা তা যাছাই করা হয়। সর্বশেষ স্তর উচ্চতর চিন্তন দক্ষতার স্তর ।এ স্তরের উত্তর লিখবে পনেরোটি বাক্যের মধ্যে।এ স্তরের জন্য বরাদ্ধকৃত নম্বর চার। এখানে যাচাই করে দেখা হয় ঐ অংশের সাথে সম্পর্কিত পাঠ্যবইয়ের জায়গা টুকুও উদ্দীপকের ভেতরকার ভাবনাচিন্তা,অনুভূতি,কল্পনাশক্তির গভীরতা-ব্যাপকতা ইত্যাদি শিক্ষার্থীরা তুলনা করে বোঝতে পারছে কিনা, এদের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য,উচিত-অনুচিত,ভালো ুমন্দ ইত্যাদি বিচার বিবেচনা করে নিজস্ব ও আলাদা দৃষ্টি ভঙ্গি সে তুলে ধরতে পারছে কিনা। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার ক্ষেত্রে যে বাক্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা হয়তো প্রথম প্রথম একটু কমবেশি হতে পারে।কারণ, আমাদের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে নবীন। উল্লেখ্য, বিজ্ঞান বা গণিত বিষয়ের ক্ষেত্রে উপমা উদাহরণ দিতে বাক্যের সংখ্যা কম বেশি হতে পারে, এতে কোনো সমস্যা নেই।
আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, তা হলো-জ্ঞানের স্তরের প্রশ্নে যেমন জ্ঞান আছে তেমনি অনুধাবন,প্রয়োগ ও উচ্চতর চিন্তত দক্ষতার স্তরের ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান আছে। কোনোভাবেই জ্ঞানের স্তরের জ্ঞান আর অনুধাবন, প্রয়োগ বা উচ্চতর দক্ষতার স্তরের জ্ঞান এক নয়। আধুনিক বিজ্ঞান মনষ্ক বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার মনোন্নয়ন, শিক্ষাদান পদ্ধতির আধুনিকায়ন। পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির প্রবর্তন আমাদের শিক্ষা ব্যবস’াকে বিশ্বমানের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আশা করি সৃজনশীল প্রশ্নপত্র আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক ভাবনার পথকে প্রশস্ত করতে পারবে।
লেখকঃ শিক্ষক প্রশিক্ষক, সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম.