বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অগ্নিঝরা মার্চ

প্রিয় স্বদেশ হেঁটে চলেছে দৃপ্ত পায়ে

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২১, ০২:৪৩

স্বাধীনতার বয়স যখন ৫০ বছর, তখন পেছনের দিকে তাকানোর সুযোগ ঘটে— নিঃশব্দ আন-মনে অথবা অজস্র শব্দ-রাজিতে সচকিত হয়ে। প্রিয় মাতৃভূমির পথযাত্রা নিয়ে ভাবি, আমাদের প্রজন্মের ফেলে আসা রাতদিনের কথা নিয়ে ভাবি।

ভাবি, পেছনের সময়গুলো যে কেবলই সত্য ও সুন্দরের ছিল, সাফল্যের ছিল, তা তো নয়; অনেক কুিসত্, অসত্য ও অসুন্দরের কাল পেরিয়েছি আমরা, যা এই স্বদেশভূমিকে যন্ত্রণার ইতিহাসে ভরিয়েছে।

পাকিস্তানি সেনাতন্ত্র ও উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার গণমানুষের যে বিদ্রোহ, তা ছিল বাঙালির বড় জাতীয় সাফল্য। আজ থেকে ৫০ বছর আগের ইতিহাস তৈরিতে বাঙালি একদিকে যেমন একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ার সাফল্য দেখিয়েছে, তেমনি জাতিসত্তা বিভাজনের বিষবৃক্ষগুলো চিহ্নিত করে সামনে অগ্রসর হওয়ার সবলতা পেয়েছে। সে ছিল এক বিশাল অর্জন, যা স্থায়ী হয়নি; আমাদের চোখের সামনে দিয়ে পুরোনো অন্ধকার আবারও ধেয়ে এসেছে। ব্যর্থতার কালিমায় কলঙ্কিত হয়েছি সবাই। সেই যখন ব্যর্থতার পাল্লা ভারী, যখন নিক্ষিপ্ত হয়েছি যন্ত্রণার কর্দমায়, জাতিসত্তার প্রতিপক্ষ দানবেরা ভাগাড় থেকে বেরিয়ে যখন রক্তস্নাত স্বাধীনতাকে তাড়া করেছে, লাখো শহিদের আত্মাকে আঘাত করেছে, মনে পড়ে, আমরা কায়মনবাক্যে তখন আবারও এক সূর্যস্নান কামনা করেছি, স্নাত হতে চেয়েছি সেই রক্তিম রস্মিতে, যা ১৯৭১-এর, আমাদের জেনারেশনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূর্যের।

৫০ বছর আগের এই মার্চ ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরির মাস, স্বাধীনতার মাস, বাঙালির জেগে ওঠার মাস। পাকিস্তানের শেষ সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে থাকে। পাকিস্তানি নায়কেরা গণরায় অস্বীকার করায় একটি শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দ্রুত সশস্ত্র আন্দোলনের পথে ধাবিত হয়, নানা পথপরিক্রমা ও রক্তপাতে সামরিক ও ধর্মকেন্দ্রিক শাসন-শোষণের পিঞ্জর ভেঙে বাঙালির স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান। অল্প দিনেই প্রমাণিত হয়, এই বিভক্তি শুধুই পতাকা পরিবর্তনের। এক উপনিবেশবাদ বিদায় হওয়ার পর জেঁকে বসেছে আরেক উপনিবেশবাদ।

কিন্তু বাঙালি তার আত্মসম্মান ও মর্যাদার সংগ্রাম থেকে পিছপা হয়নি। তারা শুরু করে মুক্তির আন্দোলন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র আইয়ুববিরোধী শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং সব শেষে ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০-এর সাধরণ নির্বাচনে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার ব্যাপক উন্মেষ ঘটে।

মার্চের শুরু থেকেই জেগে ওঠে পূর্ববঙ্গ, সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তান। ১ মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় সংসদের বৈঠক স্থগিত করে বসে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। গোটা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শুরু হয় গণপ্রতিরোধ। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাজ উত্তোলন করে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। ৩ মার্চ চলে হরতাল, অবরোধ। উত্তাল মার্চের ৭ তারিখে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি তার ইতিহাসখ্যাত ভাষণ রাখেন রমনা রেসকোর্সে। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে শেষবারের মতো সতর্ক করেন, ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন, এমনকি জাতিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা শুরু করে ইতিহাসের বর্বরতম বাঙালি গণহত্যা। বাঙালির অবিসংবাদী নেতাকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ২৬ মার্চ।

এক কথায়, গোটা মার্চ হয়ে ওঠে বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের অমলিন অগ্নিঝরা অধ্যায়। স্বাধীনতার দবিতে গোটা জাতি হয়ে ওঠে ঐক্যবদ্ধ এবং অপ্রতিরোদ্ধ। একদিকে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্ব, অন্যদিকে সাড়ে ৭ কোটি জাগ্রত মানুষের বজ্রকঠিন শপথ—‘ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫০ বছরে পড়েছে। আমরা যারা সেই ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী, একই সঙ্গে একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক, তারা সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ। কিন্তু অগ্নিঝরা মার্চ তার গৌরব নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। নতুন নতুন প্রজন্ম এসেছে। তারা জাতির স্বাধীনতা সংরক্ষণে ইতিহাসের দিকে তাকাবে, শ্রদ্ধাভরে অগ্নিঝরা মার্চের দিকে তাকাবে, তাকাবে সেই মার্চের দিকে—যে মার্চ গোটা জাতিকে একত্রিত করে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি রাষ্ট্রপিতাকে, যিনি তার জীবনের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন করেছিলেন। আমার প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্ম তাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আজ ও আগামীর বাংলাদেশ সব শোষণ-অবিচারের অবসান করবে।

আমরা যখন অগ্নিঝরা মার্চ ও স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলি, তখন স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু-মিত্রের চেহারাগুলো ভেসে ওঠে। বিশেষ করে ভেসে ওঠে সেই সব ঘাতক, যুদ্ধাপরাধী ও ঘৃণ্য মানবতাবিরোধীদের মুখ, যারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পক্ষ ধারণ করে সেদিন নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করেছিল আপন জনগোষ্ঠীর ওপর। ভাবতে বিস্মিত হতে হয় যে, এসব ঘৃণ্য অপরাধ তারা করেছিল আবার পবিত্র ধর্মের নামে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে!

বাংলার রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের বিরুদ্ধে কয়েক যুগ ধরে পরিকল্পিত আগ্রাসন পরিচালিত হয়েছে। বিশ্বাস করতে আমি বাধ্য যে, সত্য ও সুন্দরের অমোঘ বাণী হাতে ইতিহাস নিজেই আজ প্রতিরোধে নেমেছে। সব পাপ, সব কুিসত, সব অবিচার ভাসিয়ে দিতে এসেছে। শান্তি পাই, যখন দেখি বিস্তর অবরোধের মাঠ পেরিয়ে আমার প্রিয় স্বদেশ হেঁটে চলেছে সামনে, দৃপ্ত পায়ে; তৃপ্তি লাভ করি যখন দেখি বাংলার পতাকা হাতে নবতারুণ্য স্বদেশের নাম এঁকে দিচ্ছে বিশ্বের সব আঙিনায়।

হারুন হাবীব: মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

ইত্তেফাক/এএএম