শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দশ দিগন্তে

সাতই মার্চের অমরত্ব প্রসঙ্গে

আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৩:৫২

আজ ৭ই মার্চ, সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল আজ ৭ই মার্চ। ৫০ বছর আগের এই দিনটির কথা মনে পড়ল। ঢাকায় সেই দিনটি ছিল রৌদ্র উদ্ভাসিত। সারা শহর রাজনৈতিক উত্তেজনায় থমথম করছে। শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, শেখ সাহেব আজ পূর্ব পাকিস্তান, তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। মানুষ আশায়-আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল। রেসকোর্সে সভা হবে বিকেল ৩টায়। কিন্তু তার আগেই রেসকোর্স জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মিছিল রেসকোর্স ময়দানের দিকে যাচ্ছে। তাদের কণ্ঠে স্লোগান—‘আপসের মুখে লাথি মারো, স্বাধীনতা ঘোষণা করো।’

আমার বুকে সকাল থেকেই উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধু এখন কী করবেন? সারা দেশের মানুষের মনে তিনি স্বাধীনতার প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছেন। সেই প্রত্যাশা পূরণ না করলে দেশের মানুষ চরম হতাশ হবে। তার নেতৃত্বের এখানেই শেষ। তখনকার চীনপন্থি বামেরা, বিশেষ করে এনায়েতুল্লা খানের ‘হলিডে’ পত্রিকা আনবরত প্রচার করছে, শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে তলে তলে আপস করে বসে আছেন। ছয় দফার আসল দফা দুটোই তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। শিগিগরই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।

এটা ছিল প্রচারণা। আমি ভাবছিলাম বঙ্গবন্ধুর সমস্যার কথা। আজ রমনার মাঠে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে তার নেতৃত্বের আজই শেষ। জনগণ তার নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করবে। আর আজ যদি তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তাহলে পাকিস্তান আর্মিকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে, তারা হিংস্র হায়েনার মতো ঢাকা শহরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঢাকা শহর রক্তে ভেসে যাবে।

বঙ্গবন্ধুর জনসভা ডাকা হয়েছে রমনার রেসকোর্স ময়দানে। (তখনো এর নাম শহীদ সোহরাওয়ার্দী ময়দান রাখা হয়নি) এই ময়দানের কাছেই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ভবনের প্রাঙ্গণে মিলিটারি মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের হাতে হেভি আর্মস। সেই সঙ্গে ওয়াকিটকি। সর্বক্ষণ মাঠের অবস্থা তারা হেডকোয়ার্টারে জানাচ্ছে। ময়দানের আকাশে উড়ছে হেলিকপ্টার। প্রয়োজনে ময়দানের জনসভার ওপর আকাশ থেকে বোমাবর্ষণের ব্যবস্থা পাকা করে রাখা হয়েছে। ময়দানের জনতার হাতে অস্ত্র বলতে ছিল লাঠি। আর এই নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সরকার রীতিমতো বিশাল যুদ্ধের ব্যবস্থা করেছে। জনতার শক্তিকে তাদের এত ভয়।

৭ মার্চের দুই দিন আগে প্রকাশিত ফয়েজ আহমেদের সাপ্তাহিক স্বরাজ পত্রিকায় আমি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম ‘কমপ্রোমাইজ, না কন্টফ্রন্টেশন’ আজ যা লিখছি, তখন আমি এ কথাগুলোই লিখেছিলাম। মুজিব-নেতৃত্বের সামনে আজ উভয় সংকট। যদি তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় যান, তাহলে এখানেই তার নেতৃত্বের শেষ। আর তিনি যদি সামরিক জান্তার সঙ্গে কনফ্রন্টেশনে যান, তাহলে ভয়াবহ রক্তপাত অনিবার্য। অহিংস আন্দোলনের এখানেই শেষ। বঙ্গবন্ধুকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিতে হবে।’ হলিডের লেখার প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় যাবেন না। কারণ তার সামনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির উদাহরণ রয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্জাকে বিশ্বাস করে তাদের সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় গিয়েছিলেন। তার পরিণতি কী হয়েছিল বঙ্গবন্ধু জানেন।

৭ই মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু একটু দেরি করে এসেছিলেন। জনসভায় মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। জনতা উল্লাসে ও স্লোগানে ফেটে পড়ল। তার গায়ে শাদা পাঞ্জাবির ওপর কালো মুজিবকোট। তাতেই আমার কাছে তাকে মনে হচ্ছিল রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের মতো। নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় মহাকাব্যের নায়কের মতো বঙ্গবন্ধুর সেদিনের চেহারার বর্ণনা আছে।

তার বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি যখন বললেন, ‘তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো, শত্রুকে আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।’ তখনই আমি বুঝেছিলাম, অহিংস আন্দোলনের শেষ। নেতা জাতিকে কৌশলের সঙ্গে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তারপর যখন তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম,’ তখন বুঝতে বাকি রইল না, নেতা কী সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন।

একদিকে ৭ই মার্চের এই ঘোষণা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। অন্যদিকে ছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য জাতিকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ। আমাকে এক বিদেশি সাংবাদিক বন্ধু বলেছেন, তিনি বিশ্বের বহু নেতার বিবৃতি, ভাষণ পাঠ করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কোনো তুলনা খুঁজে পাননি। তিনি পাকিস্তানের আর্মির সঙ্গে ইমিডিয়েট কনফ্রন্টেশন এড়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। যদি দিতেন, তাহলে বায়াফ্রার ‘একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার’ মতো ভুল করতেন।

এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ আখ্যা দিয়ে শাসক শক্তি হিংস্র হামলা চালায়। বায়াক্রার স্বাধীনতালাভ আর ঘটেনি। এই ভুল বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু করেননি। তিনি তার অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণা শুনে হতবুদ্ধি পাকিস্তান আর্মি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে উঠতে পারেনি, এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং জাতির কাছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ কি না।

বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে যে কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় রেখেছেন, তা তার সমসাময়িক বিশ্বনেতাদের মধ্যে বিরল। তিনি এই ভাষণে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন মীমাংসারও প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি হানাদার আর্মিকে বলেছেন, ‘তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। তোমরা আমাদের বন্ধু এবং ভাই। তোমাদের কেউ কিছু বলবে না।’ এ কথায় তিনি পরিষ্কারভাবে সামরিক জান্তাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিলে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হতে পারে।

পাকিস্তানের মাথামোটা পাঞ্জাবি শাসকেরা এই শান্তির পথ বেছে নেয়নি। তারা ঢাকার টেলিভিশন ও বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার নিষিদ্ধ করে। এটা যেন উত্তপ্ত উনুনে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি নিক্ষেপ। সারা দেশ গর্জে ওঠে। বেতার ও টেলিভিশনের কর্মীরা সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য একযোগে কাজ বর্জন করেন। সারা পূর্ব পাকিস্তানের বেতার ও টেলিভিশন নীরব। সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত গোঁফ নামাতে বাধ্য হলেন। তারা ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারের অনুমতি দিলেন।

১৯৭১ সালের ৮ মার্চ। সেদিন যারা ঢাকা শহরের দৃশ্য দেখেননি, তারা এই ভাষণ কী বিপ্লব ঘটিয়েছিল, তা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেননি। আমি সেই সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। ঢাকার রাস্তায় সেদিন হাজার হাজার মানুষ নেমে পড়েছিল। প্রতিটি রেডিও, টেলিভিশন, দোকানের সামনে মানুষের ভিড়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাতে বাজছে। জনতা জয়োল্লাসে ফেটে পড়ছে।

এবারের ৭ই মার্চের গুরুত্ব এই যে, এবার মুজিব জন্মশতবার্ষিকীর বছরটি আমরা পার হয়েছি। এই ভাষণের বয়স ৫০ বছর। আমাদের স্বাধীনতারও এবার সুবর্ণজয়ন্তী পালন সম্ভব হতো না, সেই ভাষণ আজ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করার দিন। এই ভাষণের তাত্পর্যও নতুন করে ধারণ করার দিন।

স্বাধীনতার শত্রুরা এই ভাষণকেও বিকৃত করার, এর অপব্যাখ্যার চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে যেমন তারা জাতির ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারেনি, তেমনি পারেনি ৭ই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণকেও। ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার সবচাইতে বড় দিকনির্দেশনা। এই ভাষণের কোনো মৃত্যু নেই।

লন্ডন, ৬ মার্চ, শনিবার, ২০২১

ইত্তেফাক/এএএম