শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শ্রদ্ধা ভালোবাসায় অজয় রায়কে শেষ বিদায়

আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:২৪

ছেলে অভিজিত্ রায়ের লাশ কাঁধে নিয়ে বাবা অজয় রায়ের সংগ্রাম ছিল বড়ো কঠিন। তার চলে যাওয়ায় বিশাল শূন্যতা গ্রাস করেছে রাষ্ট্র ও সমাজকে। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ একদিকে যেমন শ্রদ্ধা জানালেন, অপরদিকে সবার মুখেই ছিল ছেলে অভিজিত্ রায় হত্যার বিচার দেখে যেতে না পারার দুঃখ, ক্ষোভ। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে অনেকে জানালেন, অজয় রায়কে শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে বড়ো পন্থা হচ্ছে ছেলে অভিজিত্ রায় হত্যার বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা।

অজয় রায়ের ছোটো ছেলে অনুজিত্ রায় বলেন, আমার দাদা অভিজিত্ রায়ের হত্যাকারীদের বিচার হলে বাবা স্বস্তিবোধ করতেন। সেই বেদনা নিয়েই বাবা চলে গেলেন। অনুজিত্ রায় বলেন, পিতা হারানোর বেদনা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করছি। তিনি শুধু আমার পিতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, লেখক, বুদ্ধিজীবী; সর্বোপরি একজন মুক্তচিন্তার মানুষ।

ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল অজয় রায়ের কফিন। শিক্ষাবিদ অজয় রায়কে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন অগণিত ভক্ত, ছাত্র, শুভানুধ্যায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষ। শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অধ্যাপক অজয় রায়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে বিভাগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। অজয় রায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী চিকিত্সাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য তার মরদেহ বারডেম হাসপাতালে দান করা হয়।

সেখান থেকেই বারডেম হাসপাতালে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। আর এভাবেই চিরবিদায় নিলেন আলোকিত মানুষ, পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক অজয় রায়। অধ্যাপক অজয় রায় সোমবার দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটায় অজয় রায়ের মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার বেইলি রোডের বাসভবনে। সেখান থেকে সকাল সাড়ে ১১টায় অজয় রায়ের মরদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। শুরুতেই সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় এ শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজনে যোগ দেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

আরও পড়ুন: মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ ৪ সেনা কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অজয় রায়ের নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠান। শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ ও অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ সামাদ, চিত্রশিল্পী আবুল বারক্্ আলভী, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শামসুজ্জামান খান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্ল্যাহ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রমুখ।

আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, শামসুন্নাহার চাঁপা, সুজিত রায় নন্দী, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ। বাংলা একাডেমির পক্ষে মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির পক্ষে সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল, ওয়ার্কার্স পার্টি, যুব মৈত্রী, ঐক্য ন্যাপের পক্ষে পংকজ ভট্টাচার্য, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), আদিবাসী ফোরাম, বাসদ (খালেকুজ্জামান), হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ন্যাপ, গণসংহতি আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ এ নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সন্তান হারানো আরেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, অজয় রায়ের লেখায় বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশে গড়ে ওঠার কথা বলতেন। তিনি বাঙালির ইতিহাসে গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বভৌমত্বের পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিলেন। তিনি তার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের একজন ছিলেন।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, তিনি আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন। সমাজতন্ত্রে, মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করতেন। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের তিনি প্রতিবাদ করতেন। সেটা তার ছেলে অভিজিত্ রায়ের মৃত্যুর আগেও। এ ধরনের মানুষ তৈরি হচ্ছে না। তৈরি হলে আমাদের আক্ষেপ থাকত না।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তচিন্তার জগতে তার বিশাল অবদান রয়েছে। আজকে অজয় রায় আমাদের মাঝে আর নেই। তার লেখাগুলো আছে, তার বিশাল কর্মযজ্ঞ আছে। যা নতুন প্রজন্মের কাছে বিশাল প্রেরণার উত্স হয়ে থাকবে।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, ছেলের লাশ কাঁধে নিয়ে বাবার সংগ্রাম বড়ো কঠিন। তার চলে যাওয়ায় প্রচণ্ড শূন্যতা গ্রাস করেছে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে।

ইত্তেফাক/এমআরএম