গত বছরের ৬ জুলাই রাত ৮টার দিকে সিদ্ধেশ্বরীর খন্দকার গলির ৩৫/৩৬ নম্বর হোল্ডিংসের কল্পছায়া অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সাদা রঙের প্রাইভেট কার নিয়ে বের হয় ইফরান খান রাকিব (১৬)। রাকিব মগবাজারের ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। রাকিবই গাড়িটি চালাচ্ছিল।
এরপর তার সঙ্গে মিলিত হয় সাদী, রাফিন, সাবাব, জয়সহ আরো পাঁচ-ছয় জন। এদের মধ্যে সাদী মগবাজারের কোনো একটি স্থান থেকে রাকিবের গাড়িতে ওঠে। অন্যরা নিজেদের গাড়ি নিজেরাই চালাচ্ছিল। তারা ৩০০ ফিট রোডে গিয়ে উচ্চগতিতে গাড়ি চালায়। সেখানে আড্ডা দিয়ে হাতিরঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মগবাজার ফ্লাইওভার দিয়ে বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবের সামনে আসার পর রাকিব অসুস্থ বোধ করলে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে সাদী। রাত ১০টার দিকে অফিসার্স ক্লাব থেকে সাদী, রাফিন ও সাবাব তিনটি প্রাইভেট কারে মগবাজার ফ্লাইওভার দিয়ে রওনা দেয়। ফ্লাইওভারের তেজগাঁও সাতরাস্তা প্রান্ত দিয়ে রাকিবের প্রাইভেট কারটি নামার পর স্থানীয়রা দেখতে পায় গাড়িটির সামনের দিকে বাম পাশের অংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। বিজি প্রেসের কাছে পথচারীরা গাড়িটি ধাওয়া করে। একপর্যায়ে গাড়িটি আটক করার পর পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে রাকিবকে রক্তাক্ত অবস্থায় ও সাদীকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। রাকিবকে শহিদ সোহারাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিত্সকরা মৃত ঘোষণা করেন।
রাকিবকে উদ্ধার থেকে শুরু করে দুর্ঘটনার কবলে পড়া গাড়ি এবং দুর্ঘটনার স্থান নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল রাকিবের মা-বাবার মনে। ঘটনার পরদিন রাকিবের বাবা দীল মোহাম্মদ খান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি একটি অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পায় যে মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর ঘটনাস্থলটি হাতিরঝিল থানার মধ্যে পড়েছে। তাই অভিযোগটি হাতিরঝিল থানায় পাঠিয়ে দেয়। তবে রাকিবের বাবার অভিযোগ, হাতিরঝিল থানায় মামলাটি অন্তর্ভুক্ত করার সময় এর অভিযোগে পরিবর্তন করা হয়েছে। মামলায় রাফিন ছাড়াও অজ্ঞাত দুই বন্ধুকে আসামি করা হয়েছিল। এছাড়া জয় নামের এক বন্ধু রাকিবকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এসব বিষয় এজাহার থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এরপর সাত মাস কেটে গেলেও রাকিবের মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এটি হত্যা নাকি সড়ক দুর্ঘটনা তা-ও বলতে পারছে না কেউ। বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটির তদন্ত করছে।
রাকিবের মা-বাবার দাবি, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে যখন এই পথ দিয়ে সাতরাস্তার দিকে যাচ্ছিলেন তারা তখনো দুর্ঘটনার কোনো আলামত তাদের নজরে পড়েনি। এমনকি ভোরবেলা যখন তারা দুর্ঘটনার আলামত দেখতে আসেন তখনও কোনো চিহ্ন তাদের নজরে পড়েনি। গাড়িটির সামনের বাম দিকের অংশ যেভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে তাতে রাকিবের শরীরের বিভিন্ন স্থানে কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু লাশ উদ্ধারের সময় তার নাক ও মুখে সামান্য জমাট বাঁধা রক্ত দেখা গেছে। এ ধরনের জখম হলে মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে কারো রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার কথা নয়। এমনকি গাড়িটি সাদী চালাচ্ছিল। তার শরীরের কোথাও কোনো কাটা দাগ বা কোনো ক্ষতের চিহ্ন ছিল না। পরবর্তীকালে পুলিশ গাড়িটি জব্দ করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় রাখে। গাড়ির পেছনের ডান পাশের সিটে পা রাখার স্থানে রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। অথচ বলা হচ্ছে, রাকিব সামনের সিটে বসেছিল। ওই স্থানটিতে কোনো রক্ত ছিল না।
আরো পড়ুন: চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম
অন্যদিকে সাদী ও রাফিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দাবি করেছে, মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর ট্রাকের ধাক্কায় প্রাইভেট কারের বাম পাশ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এতে রাকিব মারা যায়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করা দুর্ঘটনাস্থল মগবাজার ফ্লাইওভারের পাশেই মডার্ন হারবাল গ্রুপের কার্যালয়। এখানকার কর্মচারী জালাল জমাদার জানালেন, যে সময়টিতে দুর্ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, ওই সময়ে তারা তাদের কক্ষেই ছিলেন, একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির সংঘর্ষ এবং মানুষ মারা যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তাদের নজর এড়াতো না।
বিজি প্রেসের সামনে যেখানে জনতা ধাওয়া করে প্রাইভেট কারটি আটক করে, সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শী চা দোকানি অনিক জানান, ভাঙা গাড়ি নিয়ে ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় জনতা ধাওয়া দিয়ে রাকিবের গাড়িটি থামায়। এসময় রাকিবের বন্ধুরা তাকে রেখে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাদী নামের একজকে আটক করে পুলিশে দেয় জনগণ।
এদিকে অফিসার্স ক্লাব থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় যেখানে এসে ফ্লাইওভার শেষ হয়েছে, সেই বিজি প্রেস পর্যন্ত বহু ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু সেখানে ২০১৯ সালের ৫ জুলাই পর্যন্ত ফুটেজ থাকলেও দুর্ঘটনার দিন ৬ জুলাই থেকে কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি।
এমন নানা অসংগতির কারণে দুর্ঘটনা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন রাকিবের বাবা। তেজগাঁও জোনের পুলিশ কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থল ও মামলার এজাহারে পালটে দিয়েছেন—এমন অভিযোগ এনে প্রতিকার চেয়ে আইজিপি বরাবর আবেদন করেছেন তিনি। যেটি বর্তমানে তদন্ত করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে নিহত রাকিবের বন্ধু জয়, সাদী, রাফিন, সাবাবসহ অন্য বন্ধুদের কেউই এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তাদের প্রত্যেকের দাবি, ঘটনাটি দুর্ঘটনা। এটার সঙ্গে হত্যার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে ঘটনার দিন রাকিব গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সময় ফেসবুকে তার বান্ধবী সামিরা মেহেজাবিন শ্রাবণীর সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে কথোপকথন হয়। সেখানে রাকিব সাদী, রাফিন ও সাবাবের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতেই শ্রাবণী উল্লেখ করে, সাবধানে যেয়ো। রাকিব লিখে, ‘কেন? আমি কি ভয় পাই নাকি?’
ইত্তেফাক/এএএম