বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অচেনা রূপে ঢাকা

আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২০, ০৭:১৯

রাজধানীর বাস টার্মিনাল, ট্রাক টার্মিনাল, লেগুনাস্ট্যান্ডগুলোতে সুনসান নীরবতা। ছিল না সেই ভিড়, গাড়ির শব্দ, পরিবহন শ্রমিকদের তোড়জোড়, আড্ডা, স্ট্যান্ডে সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার চিত্র। 

ওষুধ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া বেসরকারি অফিসসহ সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ। বলতে গেলে ২ কোটি মানুষের শহর ঢাকার রাজপথ যেন পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। 

নগরীর টার্মিনালগুলো থেকে কোনো পরিবহন ছেড়ে যায়নি, আসেনি ঢাকার বাইরে থেকে কোনো পরিবহন। একসঙ্গে দুই জন চলাচলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অপরদিকে গতকাল থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য যাত্রীবাহী রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে বিমান যোগাযোগও প্রায় বন্ধ রয়েছে। তবে চীন ও লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ স্বাভাবিক আছে। 

সবকিছু বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে একসঙ্গে কার্যকর হওয়ায় হঠাত্ করেই থমকে গেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং পুরো দেশের কার্যক্রম। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্ট। অপ্রয়োজনে মানুষজন যেন রাস্তায় ঘোরাঘুরি না করে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন তারা।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক ভিডিও বার্তায় গতকাল (২৬ মার্চ) থেকে সবধরনের গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেন।

ছবি:  আব্দুল গনি

সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস-মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানিয়েছেন, গতকাল সকাল থেকে একটি বাসও ছাড়েনি। রাস্তাঘাটে নেই কোনো লোকজন। এমন পরিবেশ আর কখনো হয়নি। সায়েদাবাদ টার্মিনালে পরিবহন শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। এখন আমি তাদের রান্না করার ব্যবস্থা করছি। 

তিনি বলেন, গরিব এই শ্রমিকদের পাশে যেন সবাই এগিয়ে আসে সেজন্য আমি সরকার ও বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। একই চিত্র দেখা গেছে ফুলবাড়িয়া, মহাখালীসহ রাজধানীর অন্য পরিবহন টার্মিনালগুলোতে। 

বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারুফ তালুকদার সোহেল বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। একটি পরিবহনও চলছে না, যাত্রীও নেই।

নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত মঙ্গলবার থেকে দেশের সব রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই সদরঘাট থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। টার্মিনালেও জনশূন্যতা বিরাজ করছে। আমরা কোনো লঞ্চ চলতে দিচ্ছি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকরাও অনেক সচেতন রয়েছেন।

পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলে বাধা

গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ (ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ওষুধ, জরুরি সেবা, জ্বালানি, পচনশীল পণ্য পরিবহন) রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান জানিয়েছেন, বেশ কিছু জায়গায় পুলিশ পণ্যবাহী ট্রাক আটকে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ছবি:  আব্দুল গনি

তিনি বলেন, পণ্যবাহী ট্রাককে জেলা শহরগুলোতে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে দুধ, ডিম, মাছ, সবজির মতো পচনশীল পণ্যের ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বড়ো ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা। পাশাপাশি এ পরিবহন নেতা পণ্যবাহী পরিবহনের চালকদের সব নিরাপত্তা বজায় রেখে যানবাহন চালানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।

ট্রাকে করে ঘরে ফিরছেন মানুষ

করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি নিয়েই ঘরে ফিরছেন হাজারো মানুষ। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে গতকালও ছিল দীর্ঘ যানজট। তবে মহাসড়কটিতে যাত্রীবাহী বাসের চেয়ে ট্রাকের সংখ্যাই বেশি। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় যাত্রীরা করোনা আতঙ্কের কথা চিন্তা না করেই ট্রাকে ও পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরছেন। 

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ইফতেখার রোকস। তিনি বলেন, দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় মহাসড়কে বাসের চেয়ে ট্রাকের সংখ্যাই ছিল বেশি।

চট্টগ্রামে ফাঁকা রাজপথ

চট্টগ্রাম অফিস জানায়, করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে অধিকাংশ নগরবাসী এখন নিজ গৃহে স্বেচ্ছাবন্দি। ফাঁকা রাজপথ, অলিগলি। কোথাও নেই প্রাণের স্পন্দন। হঠাত্ দেখে মনে হয় যেন এক ভুতুড়ে নগরী।

এমনই এক থমথমে অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেল বাংলাদেশের ৪৯তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। অন্য বছরগুলোতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হলেও এবারের স্বাধীনতা দিবসে ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিকতা। 

করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়। ফলে মাঝরাত থেকে নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে শহিদ মিনারমুখী যে বিশাল জনসে াত দেখা যাওয়ার কথা ছিল, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি।

ছবি:  আব্দুল গনি

গতকাল ফাঁকা নগরীতে দিনভর টহল দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে নগরীর সব শপিং মল ও অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। তবে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী কাঁচাবাজার, মুদি দোকান, ওষুধের দোকান খোলা ছিল। রাস্তায় গণপরিবহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তবে কিছু ব্যক্তিগত যানবাহন, রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল করেছে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ ঘর থেকে বের হননি।

এদিকে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে গতকালও নগরীর বিভিন্ন সড়কে জীবাণুনাশক মিশ্রিত পানি স্প্রে করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল টিমগুলো বিভিন্ন এলাকায় পাঁচ-সাত জনের বেশি মানুষ জমায়েত হতে দেখলে তাদেরকে ঘরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। কোথাও অতিরিক্ত লোক জড়ো হলে বা কারও মুখে মাস্ক না থাকলে লাঠি হাতে তাদের তাড়া করতেও দেখা গেছে পুলিশকে।

চট্টগ্রামে ৭ জনের নমুনা পরীক্ষা

চট্টগ্রামে করোনা কিট আসার পর গতকাল সাত জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিস (বিআইটিআইডি) কেন্দ্রে এসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তবে পরীক্ষার ফলাফল গতকাল জানানো হয়নি।

ইত্তেফাক/জেডএইচ