শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যা 

সহকর্মীর পরিকল্পনায় ভাড়াটে কিলার দিয়ে হত্যা  

আপডেট : ২২ মে ২০২০, ০০:৩৬

মাইক্রোবাসটি রূপনগর ভেড়িবাঁধে ওঠার পর সহকারী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান সেলিম ইশারা দেন, নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের গলা চেপে ধরতে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি গলায় রশি পেঁচিয়ে টান দেই। তখন সহকারী প্রকৌশলী সেলিমও দেলোয়ারকে চেপে ধরেন। দেহ নিস্তেজ হয়ে গেলে উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের খালি পয়েন্টে রাস্তার পাশে লাশ ফেলে দেই। মোবাইল ফোনটি লেকে ফেলে দেওয়া হয়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর ভাড়াটে খুনি শাহীন গতকাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। শাহিনের জবানবন্দিতে  বেরিয়ে আসে চাকরি জীবনে একজন সহকর্মীকে হত্যার মর্মান্তিক কাহিনী।

গতকাল বৃহস্পতিবার তিনজনকে আদালতে নিলে শাহীন ও হাবিব আদালতে জবানবন্দি দেয়। সহকারী প্রকৌশলী সেলিমকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

গত ১১ মে দুপুরে উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর ব্রিজের কাছে জঙ্গল দেলোয়ারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই সকালে তিনি মিরপুরের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী খোদেজা বেগম তুরাগ থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

তবে প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যায তিনজন গ্রেপ্তার হলেও কেনো তাকে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলছে না। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেলোয়ার হোসেন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। সিটি কর্পোরেশনে নিম্মমানের উন্নয়ন কাজ করায় তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারের অন্তত শত কোটি টাকার বিল আটকে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কোনাবাড়ী এলাকায় এক কিলোমিটার সড়ক নির্মানে ৩৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। জাইকা, এডিবি ও আরো একটি দাতা সংস্থার নামে পৃথক বিল তৈরি করা হয়। অর্থাৎ মোট ৯৯ কোটি টাকার বিল করা হয়। একই কাজ পৃথক তিনটি সংস্থার নামে বিল উত্তোলনের বিষয়টি দেলোয়ার আটকে দেন। এছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে এলাকায় সুপেয় পানির লাইন স্থাপনে শত কোটি টাকার একটি বিল তিনি অনিয়মের অভিযোগে আটকে দেন। এই কারণেই শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। এই হত্যাকাণ্ডে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের একজন শীর্ষ জনপ্রতিনিধির যোগশাজস থাকতে পারে বলেও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আভাস দিয়েছে।

গতকাল উত্তরা পূর্ব থানায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, তারা হত্যাকাণ্ডের মোটিভ এখনও উদ্ধার করতে পারেন নি। তা উদ্ধারের জন্য তদন্ত চলছে। হত্যায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাস এবং নিহত দেলোয়ারের মোবাইল ফোনও ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

উপ-কমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন বলেন, গ্রেপ্তার শাহীন ভাড়াটে কিলার, অপর আসামি হাবিব মাইক্রোবাস চালক। তারা ঘটনার কথা স্বীকার করেছে এবং বলেছে প্রকৌশলী সেলিম তাদের ভাড়া করেছে। হত্যাকাণ্ডের সময় ওই প্রকৌশলী গাড়িতেই ছিলেন এবং তার নির্দেশে হত্যাকাণ্ড হয়। এখন সেলিম কেনো তার নির্বাহী প্রকৌশলীকে খুন করলেন, তার নেপথ্যে কেউ রয়েছে কি না তা জানতে তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তির সহায়তা এবং সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় প্রকৌশলী দেলোয়ারকে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার সময়ে একজন সাদা পিপিই পড়া ছিলেন। পিপি পড়া ব্যক্তি এক রিকশা চালকের ফোন থেকে দেলোয়ারকে ফোন দিয়ে বাসার বাইরে আসতে বলেন। পরে সেই রিকশা চালককে আটক করা হলে তিনি ১০০ টাকা  বিনিময়ে সাদা পিপি পড়া এক ব্যক্তি তার ফোনে কথা বলে বলে জানায়।

প্রকৌশলী সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম দাবি করেছিল ঘটনার দিন সকালে সে অসুস্থ থাকায় বাসাতেই অবস্থান করছিল। কিন্তু সে তার বাসার সঠিক ঠিকানা এড়িয়ে যান। এক পর্যায়ে বাসার ঠিকানা দিলেও সেটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার আগে ও ঘটনার দিন আসামি সেলিমের অবস্থান করা বাড়িটির সন্ধান পাওয়া যায়। ওই বাড়িটির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার দিন সকাল ৮:৪৬ মিনিটে সাদ পিপিই ও কালো জুতা পরে সেলিম বের হচ্ছেন। প্রকৌশলী দেলোয়ারকে যেখান থেকে মাইক্রোবাসে তোলা হয়, সেখান থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজে থাকা দৃশ্যের সঙ্গে সেলিমের বাসার ফুটেজের মিল পাওয়া যায়। এরপর ওই আসামিকে এসব দৃশ্য দেখালে সে গাড়িতে থাকার কথা স্বীকার করে। তবে কোনো প্রকৌশলী দেলোয়ারকে খুন করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনও মুখ খুলেনি। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।


ইত্তেফাক/আরকেজি