রাজধানীর পরিবহন সন্ত্রাসীরাই ৬ বছর আগে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এই ক্যাডার বাহিনীর হাতে পৃথক ৩ টি হত্যার ঘটনায় ঘটে।
রাজধানীর বাস টার্মিনাল কেন্দ্রিক এই সন্ত্রাসী চক্রটির সঙ্গে ওই সময় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আলোচিত কাউন্সিলর নুর হোসেনের যোগাযোগ ছিল। ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনে নূর হোসেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রেফায়েত উল্লাহ তোতার পক্ষে কাজ করেন। তোতার পক্ষে কাজ করতে গিয়ে নুর হোসেন তার এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জ ও ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল কেন্দ্রিক পরিবহন সন্ত্রাসীদের ভাড়া করেন। এদের মধ্যে সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল কেন্দ্রিক সন্ত্রাসী গ্রুপটির সঙ্গে গজারিয়ার উপজেলার নির্বাচনের আওয়ামী লীগ সমর্থিত আমিরুল ইসলামের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট বালুয়াকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুদ্দিন প্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। নূর হোসেনের ভাড়া করা এই পরিবহন সন্ত্রাসী গ্রুপটির হাতে নির্বাচনের দিন খুন হয় বালুয়াকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন প্রধান এবং বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল মান্নান মনার স্ত্রী লাকি আক্তার। নির্বাচনের পরদিন এই সন্ত্রাসী গ্রুপটি গজারিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক মাহবুব আলম জোটনকে গুলি করে হত্যা করে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জন খুনের ঘটনার আগে নুর হোসেন ছিল ব্যাপক প্রভাবশালী। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রভাব নারায়ণগঞ্জের বাইরে মুন্সীগঞ্জ এবং ঢাকা জেলার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে চিটাগাং রোড হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ ও কাঁচপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। সায়দাবাদ বাস টার্মিনালের একসময় বিএনপি কর্মী আক্তার ভূঁইয়া ও খোকন ভূঁইয়া সহোদরের সঙ্গে নুর হোসেন সখ্যতা। বিএনপি’র আমলে এই সহোদরকে দিয়ে নুর হোসেন পরিবহণ কোম্পানী তৈরি করে তারা সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা-কচুয়া রুটে গ্রীন সুপার পরিবহন নামে বাস চালু করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নুর হোসেনের সঙ্গে এই সহোদর দল পরিবর্তন করেন। তারা সায়দাবাদ বাস টার্মিনালের পরিবহনের কয়েকটি রুট নিয়ন্ত্রণ করে। ঢাকা- কোম্পানীগঞ্জ রুটে তিশা ক্লাসিক পরিবহন, ঢাকা-কুলিয়ারচর রুটে তিশা পরিবহন এবং ঢাকা-মাওয়া রুটে তিশা-গোধূলি ট্রাভেলস নামে শতাধিক বাস চালু করে। এক পর্যায়ে সায়দাবাদ বাস টার্মিনালের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে নুর হোসেন ও ভূঁইয়া সহোদর।
আরো পড়ুনঃ পল্লবী থানায় বোমা বিস্ফোরণ, কথিত আইএসের দায় স্বীকার
২০১৪ সালের ২৩ মার্চ গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রেফায়েত উল্লাহ তোতার পক্ষে মাঠে নামেন নুর হোসেন। ওই সময় নুর হোসেন ছিলেন ব্যাপক প্রভাবশালী। ঢাকা থেকে তার পুরাতন ক্যাডার বাহিনীকে গজারিয়ার নির্বাচনে মাঠে নামায়। নির্বাচনের আগের দিন এই ক্যাডার বাহিনী মাইক্রোবাসে করে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র রেকি করে। নির্বাচনের দিন অন্তত অর্ধশত মাইক্রোবাসে করে এসব ক্যাডার বাহিনী মহড়া দেয়। ওই দিন সহোদরের নেতৃত্বে ক্যাডার বাহিনী বড় রায়পাড়া ভোট কেন্দ্র দখল করতে যায়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা বালুয়াকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন প্রধান বাধা দেন। ঘটনাস্থলে সহোদরের নেতৃত্বে অন্তত ৩০ জন ক্যাডার প্রকাশ্যে কুপিয়ে শামসুদ্দিনকে হত্যা করে।
এ ঘটনার পর শামসুদ্দিন প্রধানের স্ত্রী মর্জিনা বেগম বাদী হয়ে আক্তার ভূঁইয়া, খোকন ভূঁইয়া, তবারক ভুঁইয়া, জাকারিয়া, মিল্টন দেওয়ান, আমান উল্লাহ দেওয়ান, ইকবাল, হেলাল উদ্দিনসহ ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন গজারিয়া থানায়।
এ ব্যাপারে নিহত শামসুদ্দিন প্রধানের স্ত্রী ও মুন্সীগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য মর্জিনা বেগম গতকাল বলেন, ‘কারা আমার স্বামীকে খুন করেছিল এটা সবাই জানে। খোকন ভুইয়া, জাকারিয়া এরা তো এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। আমি আদালতের দিকে চেয়ে আছি। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
এই মামলাটি প্রায় দেড় বছর তদন্ত শেষে সিআইডি পুলিশ ভূঁইয়া সহোদরকে প্রধান আসামী করে ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। গতকাল মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা তদন্ত শেষে ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি। এটা ছিল উপজেলা নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে ভোট কেন্দ্র দখলকে কেন্দ্র করে হত্যার ঘটনা।’
ইত্তেফাক/এমএএম