বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সম্প্রীতির উৎসব সাকরাইন

আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ০১:৪৮

ব্যস্ত নগরীর খোলা আকাশের দিকে তাকানোর সময়ই থাকে না। রাজধানীর বড় বড় অট্টালিকার ভিড়ে আকাশে নজর একটু কমই পড়ে। ঘুড়ি উড়ানোর মাধ্যমে পৌষ মাসকে বিদায়ের উপলক্ষে নীল আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পুরাণ ঢাকাবাসীর আয়োজন সাকরাইন উৎসব যা ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত। 

পুরাণ ঢাকায় হরেক রকম রঙ্গিন ঘুড়ি আর নানান ডিজাইনের ছোট বড় আকৃতির ঘুড়ি ঘুর ঘুর করে পুরাণ ঢাকার আকাশকে রঙ্গিন করে তুলছে। কোনো ঘুড়ি মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে আবার কোনো ঘুড়ি আকাশে রাজত্ব করছে। কোনো ঘুড়ি দিগন্ত ছাড়িয়ে যায় অন্য দিগন্তে আবার কোন ঘুড়ি নাটাই ছেড়ে উড়ে যায় আকাশের নীল সীমানায়। 

বাহারি রকম নামের ঘুড়ি লেঞ্জা ঘুড়ি, চাপালিশ, পঙ্খিরাজ, একরঙ্গা ঘুড়ি ইত্যাদি ৮-৫০টাকা করে বিক্রি করা হয়। তবে সুতোর দাম ছোট বান্ডিল হলে ৮০টাকা আর বড় বান্ডিল হলে ৪০০টাকার দরে বিক্রি করা হয়। ঘুড়ি উৎসবে ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণে মুখরিত হচ্ছে প্রতিটি বাড়ির ছাদ, চলছে ঘুড়ির মুক্তবাক। বাংলা গানের তালে তালে চলতে থাকে ডিজে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে উৎসবের মুখরতা। বাড়ছে আকাশে ঘুড়ির সংখ্যাও। 

ঘুড়ির এই খেলা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবদি চলতে থাকে। দিনের আলো শেষে যেমন অন্ধকার নামে তেমনি ঘুড়ি নাটায়ের কাছে এসে পৌঁছে সন্ধ্যার লাল আলোতে। শুরু হয় রাতের কসরত সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় আতশবাজি, ফানুস উড়ানো, আগুন নিয়ে খেলা, বড় বড় গ্যাস বেলুন উড়ানো, হরেক রকমের লাইটিং যা অন্ধকার আকাশকে বিভিন্ন আলোয় অলোকিত করে। আর ডিজের তালে তালে চলতে থাকে গান নাচ। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত  পুরাণ  ঢাকার সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, সদরঘাট, নবাবপুর, লালবাগ, চকবাজার, দয়াগঞ্জ , মুরগিটোলা, ধুপখোলা মাঠ, বংশাল, ওয়ারী,  ইসলামপুর,  শাঁখারিবাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তাঁতিবাজার, রায়সাহেব বাজার এলাকার মানুষ  ঘটা করে সাকরাইন পালন করে।

সাকরাইন যেভাবে আসলো: পৌষ সংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি বলে যে উৎসব দক্ষিণ এশিয়ায় পালিত হয় তারই ঢাকাইয়া নাম সাকরাইন। ভাতে পৌষ সংক্রান্তি নামেই, নেপালে এটা পরিচিত মাথি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান্ত, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এ উৎসব চলে আসছে। তবে সুস্পষ্টভাবে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হতে পারে এটা হাজার বছরের উৎসব বা তারও আগের। ১৭৪০ সালের দিকে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উড়ানো এই দিনটি কেন্দ্র করে বর্তমানে সাকরাইন একটি অন্যতম উৎসব ও আমেজের  পরিণত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ না রেখে সকলে এই উৎসব পালন করে থাকেন। দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করেন পুরাণ ঢাকার বাসিন্দারা।

সাকরাইনের আনুষ্ঠানিকতা: বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন ও মাঘ মাসের প্রথম দিন উদযাপন করা হয় পৌষসংক্রান্তি। বর্তমানে ‘পৌষসংক্রান্তি’ শুধু ‘সংক্রান্তি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে, আর পুরাণ ঢাকার মানুষ একে বলে ‘সাকরাইন’। সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সংক্রন থেকে এসেছে। সংক্রনের আভিধানিক অর্থ বিশেষ মুহূর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হচ্ছে সাকরাইন উৎসব। উৎসবটি শুরু হয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকেই। তখন উৎসবটি সনাতন ধর্মের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল আর এখন সব ধর্ম, বর্ণ পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ এই উৎসব পালন করেন। পুরাণ ঢাকার তরুণরা সারা বছর এই ঘুড়ি উৎসবের অপেক্ষায় থাকে। সাকরাইনে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে থাকেন। আর মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা দিনটিতে সকালে পিঠা, বাকরখানি মোয়াসহ নানা ধরনের খাবার বিলি করেন প্রতিবেশীদের মাঝে। সাকরাইন উৎসবকে পৌষ সংক্রান্ত্রি বা ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়।

এবারের সাকরাইন: এবারের সাকরাইন উৎসবটি বৃহস্পতিবার পুরো কর্মদিবস ও করোনাকালীন পরিস্থিতি হওয়া সত্বেও উৎসব প্রিয় মানুষের মনে এতটুকু বাধ সাধতে পারেনি ক্লান্তি। উৎসবের আমেজ ছিল সারা পাড়ায়। তবে সবটাই দালানের ছাদে। সাউন্ড বক্সের কল্যাণে দুরন্ত মিউজিক, রকমারি আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে চারপাশ। রাত যত বাড়ে, তত যেন বাড়ে রঙ।

শীত বুড়িকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাণের উৎসব সাকরাইন প্রাণ সঞ্চার করে মানুষের মাঝে। সারাদিন আকাশে নানান রঙ্গের হাজার হাজার ঘুড়ি উড়িয়েছেন পুরাণ ঢাকাবাসী। দিনব্যাপী এই ঘুড়ি উড়িয়ে নিজের মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তির স্বাদ গ্রহণ করেন তারা। স্থানীয়রা জানান, পৌষের শেষে জামাইরা শ্বশুরবাড়ি এলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো ঘুড়ি ও নাটাই। সব বাড়ির জামাইরা ঘুড়ি ওড়ালে ঘটা করে সেসব দেখতেন সবাই। তবে এমনটা এখন আর হয় না। শহর তার শীতের তীব্রতা খুইয়েছে। কিন্তু উৎসবটা এখনও রয়ে গেছে। তাই ঘুড়ি উড়ানো পৌষ বিদায়ী উৎসবের অংশ হয়ে আছে।

পুরাণ ঢাকার অনেক স্থানীয় বাসিন্দা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বসবাস করলেও তারাও এই দিনকে কেন্দ্র করে পুরাণ ঢাকার সাকরাইন উৎসবে অংশ নেন। সবার মধ্যে একধরনের উৎসবের আমেজ কাজ করে।

ইত্তেফাক/এসআই