গণপরিবহনে যাতায়াতে নারীদের যে ভোগান্তি, করোনাকালে তা চরমে উঠেছে। যদিও নারী-পুরুষ উভয়কেই যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তবে নারীদের এ ভোগান্তি যেন একটু বেশি। সড়কে যাতায়াতে ভোগান্তি করোনাকালে তা চরম আকার ধারণ করার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন কয়েক জন ভুক্তভোগী।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রীমা আক্তার। তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ধাপে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার শর্তে সরকার বাসের ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে। কিন্তু বাস ঠিকই গাড়ি ভর্তি করে যাত্রী নেয় বলে অভিযোগ করেন রীমা আক্তার। তিনি বলেন, বসুন্ধরা থেকে আমি বনশ্রী আসার জন্য একটি বিআরটিসি দোতলা বাসে উঠি। সেই বাসের হেলপার সবগুলো আসনে যাত্রী নেয়, দাঁড়িয়েও যাত্রী নেয়। রীমা বলেন, আমার পাশের সিটে আমি কাউকে বসতে দেইনি, নিয়ম অনুযায়ী। এবার ভাড়া নেওয়ার সময় ৫০ টাকার নোট কন্ডাক্টরের হাতে দিলে, সে ২০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা নেয়। তিনি বিষয়টি ৯৯৯ ফোন দিয়ে জানাতে গেলে, তখন কন্ডাক্টর তাকে তার গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে টাকা ফেরত দেয় এবং অনুরোধ করে বিষয়টি না জানাতে।
সুমাইয়া ইসলাম নামে আরেক নারী বলেন, সকাল ৮টায় অফিস পৌঁছানোর জন্য আমাকে ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়, আমি নতুন মা, আমার বাচ্চার খাবার তৈরি করে, পরিবারের সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয় সকাল ৬টায়। কিন্তু তার পরেও প্রায় দিন অফিসের উপস্থিতিতে লাল দাগ পড়ে। অফিস করেও বেতন কাটা যায়। অফিস থেকে বাসায় ফিরতে আরো দুই ঘণ্টা সময় লাগে। অফিস থেকে বাসায় ফিরে পরিবারের কাজ শেষ করে ঘুমাতে যেতে হয় রাত ১টায়। সবকিছু মিলিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, ফলে বাধ্য হয়ে চাকরিটা ছেড়ে দেই।
রীমা কিংবা সুমাইয়া নন, রাজধানীর অধিকাংশ কর্মজীবী নারীকেই পোহাতে হয় এমন দুর্ভোগ। বিশেষ করে অফিস টাইমে এবং অফিস শেষ হওয়ার পর এ দুর্ভোগ যেন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একশন এইডের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হন। পর্যাপ্ত নারী আসনের অভাব, ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠতে না পারা, বাসের ভেতর গাদাগাদি করে দাঁড়ানোসহ নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় রাজধানীর নারী যাত্রীদের।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, সরকারি ‘বিআরটিসি মহিলা বাস সার্ভিস’ ও অন্যটি বেসরকারি ‘দোলনচাঁপা মহিলা বাস সার্ভিস’ চালু রয়েছে ঢাকার নারী যাত্রীদের জন্য। এর মধ্যে বিআরটিসি মহিলা বাস সার্ভিস মহিলা যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে ২০১২ সালে মাত্র আটটি বাস চালু করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন। এরপর বিভিন্ন সময়ে ১৫টি রুটে বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৭টি করা হয়। বর্তমানে কাগজে-কলমে ১৭টি বাস চালু থাকলেও বাস্তবে সবগুলো চলছে না বলে জানা যায়। বেসরকারি উদ্যোগে ২০১৮ সালে ঢাকায় চালু হয়েছে ‘দোলনচাঁপা মহিলা বাস সার্ভিস’।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে হারে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে, সে হারে নারীদের যাতায়াতের জন্য বাড়ছে না সুযোগ-সুবিধা। যেসব পরিবহন আছে, সেগুলো সকাল বেলা কিংবা বিকাল ৫টার পর উঠতে যাওয়া মানে যুদ্ধ করা। অধিকাংশ নারীই তখন বাসে উঠতে পারেন না। কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তি আর হয়রানি অন্য যাত্রীদের তুলনায় বেশি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক বলেন, গণপরিবহনের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে নারীদের ভোগান্তি একটু বেশি। তিনি বলেন, ফিটসেনবিহীন গাড়ি এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হওয়ায় রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কম। যা ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে দেয়।
ইত্তেফাক/এমএএম