শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শ্বাসকষ্টে ভুগছেন ঢাকার ৮৪ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ

আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২১, ০২:১৪

‘ঘুমের মধ্যেও উচ্চ শব্দে আঁতকে উঠি। সব সময় কানে শব্দ বাজতে থাকে। বাসায় টিভি দেখতে গেলেও সমস্যা হয়। আমি ভলিউম বাড়িয়ে দিলেও পরিবারের সদস্যরা কমিয়ে দেয়।’ ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলছিলেন রাজধানীর আগাঁরগায়ে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক সদস্য রফিজ উদ্দিন। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা রফিকুল ইসলামও বললেন, ‘সারা দিন রাস্তায় থাকার কারণে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষণ দাঁড়ানোর ফলে হাঁড় ক্ষয়ে যায়। মাসল ব্যথা হয়। পায়ের নিচে ব্যথা করে। প্রচুর মাথা ব্যথা হয়, চোখ জ্বালা-পোড়া করে।’

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের ৮৪ ভাগ সদস্যই শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আর শ্রবণশক্তি কমে গেছে ৬৪ শতাংশ সদস্যের। মূলত রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করায় বায়ু ও শব্দদূষণের কারণেই এসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ৩৮৪ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের ওপর পরিচালিত এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের জার্নাল অব মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল রিসার্চে।

করোনা: ছুটি বাতিল, - banglanews24.com

গত মে মাসে প্রকাশিত ঐ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধূমপায়ী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় পড়ার হার ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর অধূমপায়ীদের মধ্যে এ হার ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ। বায়ুদূষণ নিয়ে করা আরেকটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ৪০ শতাংশ ট্রাফিক সদস্য ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। ঘুমের মধ্যে ৫৬ শতাংশ কানে সার্বক্ষণিক বিকট শব্দ ‘শুনতে’ পান। ২৭ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

বায়ু ও শব্দদূষণের ফলে ঢাকা শহরের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে এই গবেষণাটি করেছেন ডা. শাকিলা ইয়াসমিন। আইইডিসিআরের একটি প্রকল্পে সম্প্রতি কাজ শেষ করা এই চিকিত্সক ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, ‘২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি এই কাজটি করেছি। সেখানে যেটা পাওয়া গেছে, সেটাই রিপোর্টে উঠে এসেছে। এখন রিপোর্ট ধরে যদি প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয় তাহলেই আমার কাজের সার্থকতা।’

রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. আবু নোমান ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের কাছে ট্রাফিক বিভাগের যে সদস্যরা আসেন তারা অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, ক্যানসার, রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া, শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া, তীব্র মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, চোখের প্রদাহ, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ হার্টের সমস্যায়ও ভোগেন। চাকরি জীবনে আমি দেখেছি, ওদের চাকরি শেষ হতে হতে আয়ুষ্কালও প্রায় শেষ হয়ে আসে।’

শব্দদূষণ, ধুলাবালি আর রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। ট্রাফিক সদস্যরা বলছেন, সারা দিন রাস্তায় থাকার ফলে রাতে তাদের ঠিকমতো ঘুম হয় না। হাত-পায়ে জ্বালা-যন্ত্রণা হয়। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।

ঈদের দিন ও সড়ক স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে ট্রাফিক পুলিশ

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘ট্রাফিক সদস্যদের এই সমস্যাগুলো তো আমরা অনেক দিন ধরেই জানি। কিন্তু প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা তো করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি আমি দেখেছি, সঠিক সময়ে মূত্রত্যাগ করতে না পারায় অনেক ট্রাফিক সদস্যের কিডনি পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা একজন সদস্য চাইলেই সরে একটু দূরে যেতে পারেন না। কারণ, তিনি সরে গেলেই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হবে। ফলে দীর্ঘক্ষণ তাকে মূত্র চেপে রাখতে হয়। এতেই রোগব্যাধিটা বাড়ছে। আমি ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থা করেছিলাম, কিন্তু সেটাও ভালো দেখায় না। ফলে এখন আমরা ফ্লাইওভারগুলোর নিচে টয়লেট নির্মাণের জন্য সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কথা বলব। যেটা শুধু ট্রাফিক সদস্যরা ব্যবহার করবেন।’

ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, ‘যেকোনো সিগন্যালে দেখবেন চারদিক দিয়ে বিনা কারণে হর্ন বাজানো হয়। এখন মানুষ যদি সচেতন হয়, বিনা কারণে হর্ন বাজানো বন্ধ করে তাহলে হয়তো শব্দদূষণ থেকে আমরা কিছুটা মুক্তি পেতে পারি।’

এদিকে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে সিসা, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রো-কার্বন, ওজোন গ্যাস, কার্বন মনো-অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান ও নানা ধরনের বস্তুকণা রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র শব্দদূষণ। আর এসব দূষণের প্রধান শিকার হচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা।

কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের অধিকাংশই পরিবেশ দূষণের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এসব রোগীর বেশির ভাগই মাথাব্যথা, পেটব্যথা, ‘ড্রাই আই’ বা চোখে পানিশূন্যতা, চুলকানি, অন্ত্রের সমস্যা, রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া, পাইলস, পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া, চুল উঠে যাওয়াসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত।

গত বছর ডেনমার্কের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মোটর গাড়ির হর্ন, সাইরেন ও অন্যান্য ‘ট্রাফিক নয়েজে’র কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ে ২৭ ভাগ পর্যন্ত।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি