বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাজধানী জুড়ে ‘বাসাভাড়া’ সাইনবোর্ডের ছড়াছড়ি

আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২১, ১০:২১

রাজধানী জুড়ে এখন শুধু বাসা ভাড়া বা ‘টু-লেট’-এর ছড়াছড়ি। অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষের বসতি—সবখানেই ঝুলছে ‘টু-লেট’ সাইনবোর্ড। আয় কমে যাওয়ায় মানুষ তার খরচের খাত কমাতে বাধ্য হচ্ছেন আর সে কারণেই খরচ কমাতে ভাড়া বাসা ছেড়ে কেউ কেউ গ্রামে ফিরছেন। কেউ সরে যাচ্ছেন রাজধানীর উপকণ্ঠে। করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসেনি। ফলে মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা যেমন মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে ারেনি, তেমনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাকেন্দ্রে যারা কাজ করেন, তারা এখনো করোনার অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি, যার কারণে প্রতিটি পরিবার নিজেদের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই ভাড়া কমাতে ফ্ল্যাট বাসা ছেড়ে উঠছেন শহর থেকে দূরে টিনশেড ঘরে। বড় ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠছেন ছোট ফ্ল্যাটে। করোনা পরিস্থিতির কালো মেঘ কবে কাটবে, সেই আশায় এখন দিন গুনছেন তারা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ তো কমানো সম্ভব নয়। ফলে বাসা ভাড়া, পরিবারের মাসিক খাওয়ার খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছি। যদি পরিস্থিতি ভালো হয়, সেই আশায় দিন গুনছি। তানজিব আলম একটি বেসরকারি ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। করোনা সংক্রমণ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি চাকরি হারান। এ সময় অন্য কোনো ব্যাংকেও চাকরি না পেয়ে অবশেষে পরিবার নিয়ে বসিলা ব্রিজের পরে আটি বাজারে বাসা নিয়ে চলে গেছেন। বিক্রি করে দিয়েছেন ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়িটি। জমানো টাকা ভেঙে খেয়ে সেটাও এখন তলানিতে। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। দিশেহারা অবস্থায় দিন কাটছে তার।

জাকারিয়া খোকন মোহাম্মদপুরে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করতেন। বাস ও পিকআপ ভ্যান ছিল তার। করোনার পর কয়েক মাস পরিবহন বন্ধ থাকায় বাস বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করেন। পিকআপ ভ্যানে যেটুকু আয় হয় তা দিয়ে রাজধানীতে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। তাই এ বছরের শুরুতে বউ-বাচ্চা পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। এখন মেসে থেকে আয় বাড়ানোর পথ খুঁজছেন।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণসহ সব খাত স্থবির হয়ে পড়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন রাজধানীসহ দেশের লাখ লাখ মানুষ। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা অর্থসংকটে পড়েছেন। ভালো চাকরি করলেও কোনো কোনো অফিস বেতন কমিয়ে দিয়েছে কিংবা লোক ছাঁটাই করায় অনেকেই চোখে সরষে ফুল দেখছেন। কাজ হারিয়েছেন করপোরেট হাউজের চাকরিজীবী থেকে শুরু করে গৃহশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, হোটেল শ্রমিকসহ সব খাতের শ্রমজীবী।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অর্থাভাবে মানুষ বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ভাড়া কমিয়ে হলেও ভাড়াটিয়া রাখার চেষ্টা করছেন অনেক বাড়িওয়ালা। কিন্তু কাজ না থাকায় সেই সামর্থ্যও নেই অনেকের। করোনার সংক্রমণ শুরু হলে বিশ্ব জুড়েই ব্যবসায় ধস নমে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারেই থমকে যায়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক থেকে শুরু করে সেই প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জীবনে চরম দুঃসময় নেমে আসে। গত দেড় বছরে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অগণিত মানুষ। আয় কমেছে বহু লোকের। যার ফলে খাবারের চাহিদা মিটিয়ে বাসা ভাড়া পরিশোধ করা এদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। বাসা ভাড়া দিতে না পেরে অনেকেই ছেড়ে গেছেন ঢাকা। কেউবা অপেক্ষাকৃত ছোট বাসায় উঠেছেন। আবার কেউ শহরের উপকণ্ঠে কম টাকার ভাড়ার বাসায় আশ্রয় গড়েছেন। গত বছরের মার্চের শেষ দিকে সাধারণ ছুটির পর অনেক পরিবার সেই যে ঢাকা থেকে গ্রামে গেছে, তাদের অধিকাংশই এখনো ফেরেনি নিজ বাসায়।

স্কয়ার হাসপাতালের উলটো পাশে একটি বহুতল আবাসিক ভবনে গত এক বছর ধরে টু-লেট ঝুলছে। ২২ হাজার, ২৬ হাজার ও ৩৫ হাজার টাকার তিনটি বাসা, কিন্তু ভাড়া হচ্ছে না। ভবনের কেয়ারটেকার বলছেন, সার্ভিস চার্জসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ মিটিয়ে মানুষ এখন ফ্ল্যট বাসা ছেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু নতুন ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না।

ভাড়াটিয়া জীবনে বিড়ম্বনা

গুলশানে একটি স্বনামধন্য রিয়েল এস্টেট ফার্মে ল অফিসার হিসেবে কাজ করেন আবিদ আজম। তিনি বললেন, ‘অফিস থেকে বেতন কমিয়ে দিয়েছে। সেই টাকায় আর ঢাকায় থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই পুরো পরিবার নিয়ে গাজীপুর চলে গেছি। সেখান থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে অফিস করি। গাজীপুরে বাসা ভাড়া কম। খরচ কমে গেছে। তবে বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি হলো। কিন্তু কিছু করার নেই। খারাপ সময়টা পাড়ি দিতে হবে তো।

রাজধানীর গুলশান, বনানি, ধানমন্ডি—এসব এলাকায় এখন ‘বাড়ি ভাড়া’র বিজ্ঞাপন ঝুলছে, কিন্তু বাসা ভাড়া হচ্ছে না। বাড়িওয়ালারা বাসায় থাকা ভাড়াটিয়াদের বাড়িভাড়া কমিয়ে দিচ্ছেন। এর পরেও অনেকে সেই ভাড়ায় থাকতে না পেরে বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাড়িওয়ালা জানান, গত দুই বছরে বাসাভাড়া বাড়ানোর তো প্রশ্নই আসে না। বাসাভাড়া কমিয়ে দিয়েও ভাড়াটিয়া রাখা যাচ্ছে না। একটা বাসা খালি হলে পাঁচ-ছয় মাসেও বাসা ভাড়া হচ্ছে না। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

ইত্তেফাক/কেকে