বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চা-দোকানি থেকে যেভাবে মানবপাচারকারী  

আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৪৪

চাকরি দেওয়ার নাম করে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরণীদের অফিসে নিয়ে আসতো একটি প্রতারক চক্র। পরে চাকরি-প্রার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নিয়োগপত্র  দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতো চক্রটি।

এই চক্রের প্রধান মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুল ছিল মুদি দোকানি। তার প্রধান সহযোগী আবু তৈয়ব ছিল  চা-দোকানি।  বুধবার (১৩ অক্টোবর)  সকাল ১০টায় রাজধানীর বাড্ডার লিংক রোডের টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালিয়ে  এই চক্রের ৮ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)-৪-এর একটি দল। বুধবার দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজার র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে (র‍্যাব) ৪- এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক এই তথ্য জানান।

No description available.

র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি কয়েকজন নারী ভিকটিমের অভিভাবকের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একইসঙ্গে  গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর বাড্ডার লিংক রোড থেকে প্রতারক চক্রটির ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো, ১। মো. সাইফুল ইসলাম উরুফে টুটুল (৩৮), ২। মো. তৈয়ব আলী (৪৫),  ৩। শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), ৪। মো. মারুফ হাসান (৩৭), ৫। মো. জাহাঙ্গীর আলম (৩৮), ৬। মো. লালটু ইসলাম (২৮), ৭। মো. আলামিন হোসাইন (৩০) ও ৮। মো. আব্দল্লাহ আল মামুন (৫৪)। 

র‌্যাব আরও জানায়, এ সময় তাদের কাছ থেকে ১০টি পাসপোর্ট, ৭ টি ফাইল, ৪ টি সিল, ১৭টি মোবাইলফোন, ৫টি রেজিস্টার, ৩টি মোবাইল সিম, ৪ টি ব্যাংকের চেক বই, ২টি  কম্পিউটার, ৩টি লিফলেট ও নগদ ১০ হাজার ৭০ টাকা উদ্ধার করা হয়। 

সংবাদ সম্মেলনে (র‍্যাব) ৪- এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন ‘অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এইচএসসি পাস টুটুল মেহেরপুরের গাংনী থানার কামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার হিসেবে কাজ করতো। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতো। অতি অল্পসময়ে অধিক টাকার মালিক হওয়ার লোভে ধীরে ধীরে মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। একসময় চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় প্রতারণামূলকভাবে ‘টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ’ নামে ৩টি ওভারসিজ এজেন্সির অফিস খোলে। এসব ওভারসিজের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত নারী ও পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে  লাখ লাখ টাকা  হাতিয়ে নেয় সে।’

No description available.

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘টুটুলের এই প্রতারণার কাজে অন্যতম দালাল বা সহযোগী আবু তৈয়ব। সে কোনো পড়াশোনা জানে না। চায়ের দোকানদারি করতো।   টুটুলের প্ররোচনায় মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এই আবু তৈয়ব। এরপর বহু লোককে প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে পাঠানো ছাড়াও  দেশের চাকরি দেওয়ার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘তৈয়ব নিজেকে একটি স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিতো। আর দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনসহ নামি-দামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকজন ভিকটিমকে ভুয়া নিয়োগপত্রও দিয়েছে সে।’

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়,  মানবপাচার চক্রের  বাকি সদস্যরা  মাঠপর্যায়ে লোক সংগ্রহ, প্রার্থীর কথিত পাসপোর্টের ব্যবস্থা, ভুয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিক্যাল পরীক্ষার মতো কাজে সহয়তা করতো।

No description available.

যেভাবে  চক্রটি প্রতারণা চালিয়ে যেতো

১। পাচারকারী চক্রের কিছু সদস্য দেশের বেকার ও অসচ্ছল তরুণ-তরুণীকে সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতো। এরপর তাদের ঢাকায় এনে  টুটুল ও তৈয়বের কাছে নিয়ে আসতো। টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে আসা ভিকটিমদের বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ‘ভুয়া মানি রিসিট দিয়ে ভিকটিম প্রতি ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করতো। 

২। পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের উচ্চশিক্ষিত দাবি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভিকটিমদের কাজের প্রশিক্ষণ দিতো। এভাবে ভিকটিমদের কাছে আস্থা অর্জন করতো।

৩। এই পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের অফিস স্টাফ বলে পরিচয় দিতো। এরপর ভিকটিমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করার কথা বলে ভিকটিমদের কাগজপত্র সংগ্রহ করতো। এরফলে ভিকটিমদের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকতো না। এই চক্রের কিছু সদস্য পাসপোর্ট অফিসের দালালদের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তুলে ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি করে দিতো।

র‍্যাব জানায়,  চক্রটি মূলত নারীদের বিদেশে চাকরি পাঠানোর নামে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্ডান ও লেবাননে পাচার করতো। 

ইত্তেফাক/কেএইচ/এনই/এএএম