শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘সমাজের বাধা পেরিয়ে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে’

আপডেট : ২৩ মার্চ ২০১৯, ২৩:৫৯

সমাজের বাধা পেরিয়ে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি। যারা ‘অনন্যা’ হয়েছেন তাদের অনুসরণ করে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীরা ‘অনন্যা’ হয়ে উঠবেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের আলোর পথ দেখাবেন। 

গতকাল অনন্যা শীর্ষ দশ পদক প্রদান অনুষ্ঠানে সম্মাননা পাওয়া নারীরা এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হলো অনন্যা শীর্ষ দশ-২০১৮ প্রদান অনুষ্ঠানে। বৈষম্য, নির্যাতন ও নানা বাধাবিঘ্নের বিরুদ্ধে নারীর মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিজেদের সক্ষমতা ও অগ্রগতিকে তুলে ধরছেন, এমন দশ নারীকে তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘অনন্যা শীর্ষ দশ-২০১৮’ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

এবারের সম্মাননাপ্রাপ্ত বিশিষ্ট নারীরা হলেন- ডা. সায়েবা আক্তার (চিকিৎসা), পারভীন মাহমুদ (ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন), এসপি শামসুন্নাহার (প্রশাসন), আফরোজা খান (উদ্যোক্তা), সোনা রানী রায় (কুটিরশিল্প), লাইলী বেগম (সাংবাদিকতা), নাজমুন নাহার (তারুণ্যের আইকন), সুইটি দাস চৌধুরী (নৃত্যশিল্পী), রুমানা আহমেদ (খেলা) ও ফাতেমা খাতুন (প্রযুক্তি)।

শনিবার বিকালে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে পাক্ষিক অনন্যা এ সম্মাননা প্রদান করে। কৃতী নারীদের দেয়া হয় উত্তরীয়, ক্রেস্ট ও সনদপত্র। সম্মাননা তুলে দেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক এমপি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা ও সভাপতিত্ব করেন অনন্যার সম্পাদক ও প্রকাশক তাসমিমা হোসেন।

কথাশিল্পী ঝর্না রহমানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই সাধনার নৃত্যশিল্পী সুইটি দাস ও তার দল মনিপুরী নৃত্য প্রদর্শন করেন। এরপর এবারের সম্মানিত দশজন নারীর উপর নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। তবে, বিশেষ কাজে অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি ড. সায়েবা আক্তার ও শামসুন্নাহার। তাদের পক্ষে পরিবারের সদস্যরা এ সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন।

পাক্ষিক অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, দেশে নারী ব্যক্তিত্ব যাদের এখন সমাজে নানা ভূমিকা রাখতে দেখা যায় তাদের প্রায় বেশিরভাগ নারীকেই প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে অনন্যা। এটা অনন্যার জন্য খুব গর্বের জায়গা।

তিনি বলেন, নারীদের প্রতি অনাচারের কথা নারীদেরই বলতে হবে। দাবি না তুললে, কথা না বললে সমাজ থেকে অন্ধকার দূর হবে না। তিনি বলেন, এখনও সময়টা নারীদের জন্য খুব অনুকূল নয়। যৌন নিগ্রহ সমাজ থেকে এখনো দূর করা যায়নি। উগ্র মৌলবাদীরা নারীর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের বঞ্চনার কথা বলতে এখনো মেয়েরা ভয় পায়। বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার। সরকারও নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান সুসংহত করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সমাজের বাধা পেরিয়ে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি।

ক্রিকেটার রুমানা আহমেদ বলেন, ক্রিকেটে আমরা নারী ও পুরুষ আমরা সমানভাবেই এগিয়ে যেতে চাই। আমরা হয়তো পুরুষ দলের মত শক্তিশালী হইনি। কিন্তু আমরা এশিয়া কাপ জয় করে দেখিয়ে দিয়েছি আমরা পুরুষ দলের চেয়ে এগিয়ে আছি। তবে, আমরা সবাই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি- এটাই গৌরবের।

পারভীন মাহমুদ বলেন, নারীর জন্য, দেশের যে কোন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আমি কাজ করার চেষ্টা করেছি। পড়াশোনায় আমার ৭-৮ বছরের গ্যাপ ছিল। কিন্তু আমি আমি আমার লক্ষ্য থেকে সরে যাইনি। এ পথে আমার পরিবার আমার শাশুড়ি খুব সহযোগিতা করেছেন। আমি যেন আগামিতেও কাজ করতে চাই। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সবাই মিলে যেন এগিয়ে যেতে পারি।

উদ্যোক্তা আফরোজা খান বলেন, আমি দুপরে অফিসে খাবার সাপ্লাই দিচ্ছি। এক দেড় বছরের মধ্যেই মানুষের বিপুল সাড়া পেয়েছি। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বমান নিশ্চিত করা খুব কঠিন। কিন্তও আমি সেই বিশ্বমান নিশ্চিত করেছি।

নাজমুন নাহার বলেন, আমি কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার প্রতি যারা আমাকে এই সুন্দর পৃথিবী দেখা হতো না। নাজমুন নাহার ১২৫টি দেশ ঘুরেছি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বের দুইশটি দেশ ভ্রমণের প্রত্যাশা রয়েছে। আত্মপ্রত্যয় থাকলে পৃথিবী যেমন জয় করা সম্ভব তেমনি অনন্যা পুরস্কারও জয় করা সম্ভব।

মনিপুরী নৃত্য শিল্পী সুইটি দাস চৌধুরী বলেন, শিল্পীরা চর্চা করেন শিল্পকে ভালোবেসে। কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়। সেই কাজের জন্য এ পুরস্কার পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় সম্মান।

সাংবাদিক লাইলী বেগম বলেন, নারী সাংবাদিক হওয়ার কথা ছিল না। প্রয়োজনের টানে আমি কাজ শুরু করি। কিন্তু নানা কাজ করে আমি সাংবাদিকতা শুরু করি। মফস্বলে মেয়েদের সাংবাদিকতা করা খুব কঠিন। কিন্তু আমি সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। 
১৯৯৩ সাল থেকে অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। প্রতিবছর নিজ নিজ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে দেশের ১০ জন বিশিষ্ট নারী এই সম্মাননা দেয়া হয়। এ পর্যন্ত ২৫০ জন কৃতী নারী পেয়েছেন এই সম্মাননা। নারীর চোখে বিশ্ব দেখার প্রত্যয় নিয়ে পাক্ষিক অনন্যা প্রকাশনার ৩১ বছর পেরিয়ে এলো। সেইসঙ্গে পেরিয়ে এলো অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা প্রদানের ২৫ বছর। তাই গতকালের অনুষ্ঠানটি একটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসার সফলতার কথা যেমন জানান দিল তেমনি আয়োজকদের কথায় ফুটে উঠলো নতুন প্রত্যয়।

সমাজের নানা ক্ষেত্রে গুণী নারীরা এ ‘অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা লাভ করেছেন। রাজনীতিতে একদিকে যেমন রয়েছেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি এ সম্মাননা লাভ করেছেন ১৯৯৬ সালে। দেশের প্রথম নারী স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরীও ২০১৩ সালে লাভ করেছেন  এ সম্মাননা। ২০০৭ সালে অবরুদ্ধ সময়ে রাজনীতিতে ভয়হীন সক্রিয়তার কারণে এ সম্মাননা লাভ করেছিলেন ডা. দীপুমনি। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০০ সালে এ পুরস্কার লাভ করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য শিল্পী মমতাজ বেগম। সেই সময় সারাদেশে জনপ্রিয় হলেও দেশের শহর অঞ্চলে তখনও তার গুণের খবর এসে পৌঁছায়নি। পাক্ষিক অনন্যাই তাঁকে খুঁজে শিল্পীর গুণের স্বীকতি দিয়েছিল।

ইত্তেফাক/আরকেজি