বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পার্কগুলোর দুরবস্থা

আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৯, ০৩:০৭

মেগাসিটি ঢাকার ‘ফুসফুস’ পার্ক। কর্মব্যস্ত মানুষ যান্ত্রিক শহরের আকাশচুম্বি দালান-কোঠার ভিড়ে দু’দন্ড স্বস্তির নিশ্বাস নিতে আর কিছুটা সময় খোলা আকাশের নিচে কাটানোর জন্য ছুটে যান সবুজে ঘেরা রমনা পার্কে, সোহরাওয়ার্দী, চন্দ্রিমা কিংবা ওসমানী উদ্যানে অথবা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেনে। কিন্তু এই উদ্যানগুলো নাগরিকদের কাছে এখন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে! দখল আর অযত্ন-অবহেলায় রাজধানীর বেশিরভাগ পার্কেরই অবস্থা এখন বেহাল। যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়, ছিনতাইকারী, হকার এবং টোকাইদের দৌরাত্ম্য, অসামাজিক কার্যকলাপ, প্রবেশপথে নানা প্রতিবন্ধকতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশসহ অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে পার্কগুলো।

নগরবাসীর চিত্তবিনোদন, শরীরচর্চা, সপরিবারে ঘুরে বেড়ানো কিংবা একটু অবসর কাটানোর সুযোগটুকুও যেন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোররাও গৃহবন্দি জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। কেবল রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী বা চন্দ্রিমাই নয়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ পার্কের পরিবেশই নষ্ট হয়ে গেছে। এই উদ্যানগুলোতে আয়েশে ঘুরে বেড়ানোর উপায় নেই। ভবঘুরে, মাদকসেবী, মাস্তান, ছিনতাইকারী, যৌনকর্মী ও পুলিশের যুগপত্ অত্যাচারে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষজন। অন্যদিকে অবৈধ দখলদারি এবং অব্যবস্থাপনার কারণে পার্কগুলোতে গাছ-গাছালির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান মতে, রাজধানীতে গাছপালার পরিমাণ মাত্র ৭ শতাংশের কাছাকাছি, যার অধিকাংশই রয়েছে নগরীর এই পার্ক ও উদ্যানগুলোতে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি ছিমছাম ও সুন্দর নগরীর জন্য নগরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ খোলা মাঠ ও পার্ক থাকা প্রয়োজন। অথচ আছে মাত্র ৪ শতাংশ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি পার্কের মধ্যে নানা অশোভন কাজে লিপ্ত থাকে। এক শ্রেণির প্রেমিকজুটির নির্লজ্জ উচ্ছৃংখলতায় ভদ্র মানুষ পার্কে টিকতে পারেন না। রাতের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে ওঠে মাদক ব্যবসায়ী-মাদকসেবী ও ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের স্বর্গরাজ্য। উদ্যানের ভেতরে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়। মাদকদ্রব্যের বেশির ভাগ গ্রাহক ছাত্র-ছাত্রী। এই উদ্যানে পুলিশকে ডিউটি দিতে দেখা যায়, তবে তাদেরকে উেকাচ দিয়ে তাদের নাকের ডগায় চলে মাদক বিক্রি ও অসামাজিক কর্মকান্ড। রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান ও বোটানিক্যাল গার্ডেন রাতে বন্ধ থাকায় সেখানে রাতে অসামাজিক কর্মকান্ড হয় না। তবে দেখা গেছে, দিনের আলোতে রমনা, চন্দ্রিমা উদ্যানে স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে ইউনিফর্ম পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিচ্ছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী, মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীরা ঘুরে বেড়ায়। সাধারণ দর্শনার্থীরা তাদের প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার একশ্রেণির লোক পার্কের ফুল পেড়ে বিক্রি করছে। নষ্ট করছে গাছ।

‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’ এর উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবে সম্প্রতি ‘ঢাকার পার্ক ও খেলার মাঠ’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, রাজধানীর পার্কগুলোতে ভদ্রলোকদের ঢোকার অবস্থা নেই। ঢাকা শহরের ৭০ ভাগ ওয়ার্ডে কোনো পার্ক বা খেলার মাঠ নেই। আর যেসব পার্ক রয়েছে সেগুলোর অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে কোনো ভদ্রমহিলা বা পুরুষ ঢোকার মতো অবস্থা থাকে না। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং অবৈধ দখলের কারণে রাজধানী থেকে ছোট-বড় অনেক পার্ক হারিয়ে গেছে। নগরবাসী যে একটু হাঁটাহাঁটি করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে সে সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য মাথাপিছু যে পরিমাণ খোলা জায়গা থাকা উচিত, ঢাকা শহরে তা নেই। এই খোলা জায়গা সবার জন্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিটি মানুষের জন্য অন্তত ৯ বর্গমিটার সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন। এ চিন্তা থেকেই একসময় নগর পরিকল্পনায় পার্কের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু অবৈধ দখলদারদের কারণে নগরীর ফুসফুস বলে পরিচিত পার্কগুলো এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, কাগজ-কলমে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি কর্পোরেশনে ৪৯টি পার্কের মধ্যে এখন ৩৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। দুই সিটি কর্পোরেশনের দেওয়া তথ্য মতে, ৪৯টি পার্কের মধ্যে উত্তর সিটির ২৩টি এবং দক্ষিণ সিটির ২৬টি পার্ক রয়েছে। এসব পার্কের অধিকাংশই এখন বিলীনের পথে। এসব ছোটখাট পার্ক দখল করে অসাধু চক্র গড়ে তুলছে মাদকস্পট, গাড়ির গ্যারেজ, চায়ের দোকান ও বিভিন্ন সংগঠনের ক্লাব। আর এসবই করা হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পার্কগুলোর বাইরে ও ভেতরে বসানো হয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্থায়ী ডাস্টবিন, উন্মুক্ত টয়লেট। আর ভবঘুরে, নেশাখোর ও বাউন্ডুলেদের আড্ডা তো রয়েছেই। একাধিক দর্শনার্থী ও প্রাতঃভ্রমণকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমনা ও চন্দ্রিমা উদ্যানে কিছুটা নিরাপত্তা থাকলেও অন্য পার্কগুলোতে নিরাপত্তার কোন বালাই নেই। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে কিছু সুপারিশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিটি নাগরিকের জন্য মাথাপিছু ০.০৫২ বর্গমিটার পার্ক ও ০.৫ বর্গমিটার খোলা সবুজ জায়গা থাকতে হবে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও লিডারশিপ ইন এনার্জি এনভারমেন্টাল ফর নেইবারহুড ডিজাইনের সুপারিশে এই পরিমাণ যথাক্রমে ৯ ও ২০ বর্গমিটার।

দেখা গেছে, কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে নেই রায়েরবাজার শিশু পার্কটি। পশু হাসপাতালের সামনের পার্কটির হদিস জানা নেই এলাকাবাসীর। লালবাগের রসুলবাগের পার্কটি পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। নয়াবাজারে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্কের চারপাশ বেদখল হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুরের শহীদ শাকিল পার্ক, শিয়া মসজিদ পার্ক, ইকবাল রোড পার্ক, ফার্মগেট ত্রিকোণ পার্ক, শেরশাহ সুরি লেনপার্ক, তাজমহল রোড পার্ক, লালমাটিয়া ডি-ব্লক পার্ক, হুমায়ূন রোড পার্ক দখলদারদের কবলে চলে গেছে। আজিমপুর শিশুপার্কে বসেছে কাঁচামালের দোকান। কাগজে-কলমে মুক্তাঙ্গন পার্ক থাকলেও সেখানে চলছে রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা। মতিঝিলে পার্কের এখন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাবুবাজার সংলগ্ন বংশাল থানার সামনে ইংলিশ রোডের মালিটোলা পার্কটি ঢাকা জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের দখল করে অবৈধ ট্রাকস্টান্ড বানিয়েছে। পার্কের যতটুকু জায়গা রয়েছে তার অবস্থাও খুব ভাল নয়। আলোচিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু পার্কটিও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সমপ্রতি।

এদিকে দখল হয়ে যাওয়া এসব পার্কে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, বিভিন্ন দোকান, ক্লিনিক, আড়ত, রেন্ট-এ-কার স্ট্যান্ড, গাড়ির গ্যারেজ, মালপত্র রাখার গুদাম, পাবলিক টয়লেট ইত্যাদি। ঐতিহ্যবাহী গুলিস্থানের পার্কটিও হারিয়ে যাচ্ছে।

নগরবিদদের মতে রাজধানীতে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে জনস্বার্থে পার্ক, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানোর প্রয়োজন। দখল হয়ে যাওয়া পার্ক-উদ্যানগুলো উদ্ধার করা এবং সমপ্রসারণ জরুরি। এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীবাসীকে শিগগিরই পরিকল্পিত ও পরিবেশসম্মত নগরী উপহার দেওয়া হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। পুরান ঢাকার প্রতিটি পার্ক ও খেলার মাঠ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুরনো তালিকা মোতাবেক অবশিষ্ট খেলার মাঠ ও পার্কগুলো উদ্ধার করে আধুনিকায়নের পরিকল্পনা চলছে।

ইত্তেফাক/আরকেজি