শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অর্ধশতাধিক ‘গডফাদার’ ধরতে অভিযান

আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০১:০৮

যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামধারী অর্ধ শতাধিক গডফাদারকে ধরতে মাঠে নেমেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাাহিনী। এ তালিকার মধ্যে ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া এবং গতকাল গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ নামধারী গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম। ইতিমধ্যে রাজধানীর ২৫টি ক্যাসিনোর তালিকাও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক ক্যাসিনো রয়েছে।

রাজধানীর ক্যাসিনোতে প্রতিদিন উড়ত শতকোটি টাকা। শুধু এই সরকারের আমলে নয়, এই ক্যাসিনোর নামে অবৈধ বাণিজ্য বিগত সরকারগুলোর আমলেও ছিল। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে আসছে। অবৈধ ক্যাসিনো, টেন্ডাবাজি, চাঁদাবাজরা কেউই প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নয়। তারা কোটি কোটির অবৈধ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলের নেমপ্লেট ব্যবহার করে আসছে। গ্রেফতারকৃতরা এ তথ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রকাশ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় বসে বছরের পর বছর চলে আসছে এই অবৈধ কারবার। তবে এবার সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনাকারী গডফাদারদের ধরতে শুরু করেছে। গতকাল শুক্রবার যুবলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি চালিয়ে আসা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ও তার দেহরক্ষীকে নিকেতন এলাকা থেকে র্যাব অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে। এর আগে বুধবার রাতে গুলশানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। তালিকাভুক্ত গডফাদার ও তার সহযোগীরা পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বিমানবন্দর ও সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ নজরদারি রেখেছে। জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ ভূঁইয়া ক্যাসিনোর অবৈধ ব্যবসার কোটি কোটি টাকার ভাগাভাগি, কারা এই টাকার ভাগ পায় এবং বিদেশে কিভাবে তারা অর্থ পাচার করে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রকাশ করেন।

রাজধানীর কয়েকটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ, মদ, জুয়ার উপকরণ উদ্ধার ও নারী-পুরুষ গ্রেফতারের ঘটনাটি এখন ‘টক অব দ্যা ক্যান্ট্রি’। অত্যাধুনিক ও বিদেশি প্রযুক্তির এ জুয়ার আসরে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন ও মদের আসর বসে। স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে খোঁদ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় অবৈধ ক্যাসিনোর নেপথ্যে কারা? সূত্র জানায়, ক্যাসিনো পরিচালনা করেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশ যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগে অনুপ্রবেশকারী। অতীতে তারা যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল করতেন। এখন পর্যায়ক্রমে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিএমপিও ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বিরোধী অভিযান জোরদার করবে। সূত্র জানায় রাজধানীতে বড় ধরণের অন্তত একশো ক্যাসিনো বা জুয়ার আসর রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৬০টি যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি যুবলীগ নেতারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। আওয়ামী লীগ নেতাদের সংখ্যা সবচেয়ে কম। র্যাবের অনুসন্ধান সূত্র জানায়, ক্যাসিনো চলে দুইভাবে। এক ধরনের ক্যাসিনো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। আরেক ধরনের ক্যাসিনো আছে যেগুলোর সন্ধ্যার পর শুরু হয়, চলে সারারাত। রাজধানীর বহুতল ভবনের ছাদগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে ক্যাসিনো। গুলশান-বনানী-বারিধারা-উত্তরা-ধানমন্ডিসহ অভিজাত এলাকায় গেস্ট হাউজের নামে অবৈধ ক্যাসিনো চলে। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের একজন কর্মকর্তার একাধিক গেস্ট হাউজ রয়েছে গুলশান এলাকায়। রাত হলেই জমে উঠে ক্যাসিনোগুলো। দেশের বিভিন্ন এলাকার ধনাঢ্য জুয়াড়িরা ভিড় করেন সেখানে। জুয়াড়িদের পাশে বসে সঙ্গ দেন সুন্দরী তরুণীরা। তাদের অনেকে মডেল, অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিত। এ্যালকোহল পান করে বুঁদ হয়ে থাকেন নেশায়। স্বল্পবসনা এসব তরুণীরদের সেবা, খাবার, মদ সবকিছু মিলিয়ে ঢাকার বুকে এক ভিন্ন জগত রচনা করেছেন ক্যাসিনো মালিকরা। ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রকরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র, গার্ড নিয়ে চলাফেরা করেন তারা। ঢাকার অর্ধশতাধিক ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন দুই শতাধিক ব্যবসায়ী। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ক্লাব পরিচালায় উচ্চ পদে রয়েছেন এইসব অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত অনেক ব্যক্তি।

জানা গেছে, রাজধানীতে জুয়ার আসর বসতে দেয়া হবে না। কোথাও অবৈধ জুয়ার আড্ডা, ক্যাসিনো চলতে দেয়া হবে না। এসব জুয়ার বোর্ড, ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িতরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর হবে। পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ যদি ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। র্যাবের অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে ক্যাসিনো মালিকদের মধ্যে। ক্যাসিনো বন্ধ করে আত্মগোপনে রয়েছে জড়িতরা। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। প্রতিটি ক্লাব থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ টাকা নেন তিনি। এসব ক্লাবে সকাল ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যাসিনো বসে। চলে মদ ও নারীর আড্ডা। এদিকে এক সময় যুবদলের রাজনীতি করা জি কে শামীম পরে যুবলীগে ভেড়েন। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক পরিচয় দিয়েই তিনি প্রভাব খাটিয়ে আসছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় যুবলীগ বলছে, তিনি যুবলীগের কোন পদে নেই।

আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টার জন্য সিলগালা ধানমন্ডি ক্লাব

ক্যাসিনোর অর্থ অসাধু এসব নেতা রাজনীতিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসত্ কর্মকর্তার কাছেও প্রতি মাসে পৌঁছে দিতেন। বিদেশে বসে শীর্ষ সন্ত্রাসীও ঢাকার ক্যাসিনো থেকে পাওয়া অর্থের ভাগ পেত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, আমেরিকা, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের রয়েছে বিলাসবহুল সেকেন্ড হোম। অনেকের স্ত্রী, সন্তান ও পরিবার-পরিজন সেখানে থাকেন। কোটি কোটি ডলারও তারা সেখানে পাচার করছেন। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। তাদেরও তালিকা রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ক্যাসিনো চালিয়ে মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করেন তারা। ক্যাসিনোর টাকার ভাগ কে কে নিতেন তাদের নাম আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বলেছেন গ্রেফতার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গত বুধবার রাতে গ্রেফতারের পর র্যাব হেফাজতে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছেন ‘ক্যাসিনো খালেদ’। এ সময় তিনি ক্যাসিনো বাণিজ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর আরও বহু তথ্য দিয়েছেন। এই টাকার ভাগ পেতেন পুলিশের সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, সার্কেল এসি-ডিসি, রাজনৈতিক নেতা, ওয়ার্ড কমিশনার, সাংবাদিক ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা। প্রতিদিন, সপ্তাহ ও মাসিক ভিত্তিকে টাকা দেয়া হতো তাদের।

ইত্তেফাক/কেকে