বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চিকিৎসা প্রটোকল পুনর্মূল্যায়ন দাবি

আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২১, ০৪:৪৫

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত সময়ে করোনায় আক্রান্ত ২৭১ জন রোগী মারা গেছেন। অথচ এর পরবর্তী এক মাসে, অর্থাৎ ১৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১ হাজার ৪৪২ জন মানুষ মারা গেছেন। অর্থাৎ পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় মৃত্যু বেড়েছে ৫ গুণ। গত দুই দিনে করোনায় ১৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা নিয়ে দেশে মোট মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়ালো।

দ্রুত মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ চিকিৎসার অভাবে, নাকি নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে—এমন প্রশ্নের জবাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনার এবারের ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ফুসফুস ড্যামেজ করে দিচ্ছে। অসুস্থতা বুঝে ওঠার আগেই রোগীকে নিতে হচ্ছে আইসিইউতে কিংবা লাইফ সাপোর্টে। সেখান থেকে আর রোগী জীবিত ফিরছে না। তারা আরো জানান, করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার প্রোটোকল পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। এক্ষেত্রে আপডেট করা প্রয়োজন। কারণ যেহেতু করোনার ভ্যারিয়েন্ট পরিবর্তন হয়েছে, সেহেতু চিকিত্সায় কোনো ঘাটতি আছে কিনা সেটিও দেখা দরকার।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. খুরশীদ আলম বলেন, ভ্যারিয়েন্টের কারণে চিকিৎসা প্রোটোকলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বের কোথাও পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বে করোনা চিকিৎসার যে প্রোটোকল আমাদেরও একই প্রোটোকল। ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়নি।

৩৬ জেলায় আইসিইউ নেই

এদিকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে করোনা রোগীর প্রচণ্ড চাপ। অক্সিজেন ও আইসিইউ সংকট প্রকট। সময়মতো রোগীরা অক্সিজেন ও আইসিইউয়ের সাপোর্ট পাচ্ছেন না। দেশের ৩৬ জেলায় আইসিইউ না থাকায় করোনা রোগীরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। এসব জেলার রোগীরা রাজধানীতে আসছেন। রাজধানীর পাঁচ সরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনা রোগীর চাপে আমরা দিশাহারা। চাহিদার তুলনায় অক্সিজেনের সংকট। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৮৭ ভাগই আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত।

এদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের এক বছর যাবৎ দাফনের কাজ করছে ঢাকার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আল-মারকাজুল ইসলাম। সংস্থাটির এক জন কর্মী বলছেন, গত দুই সপ্তাহ যাবত এত বেশি মৃতদেহ দাফন করতে হচ্ছে যে পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। একের পর এক মৃতদেহ দাফন করছেন তাদের কর্মীরা। গত দুই সপ্তাহ যাবত মৃতদেহ দাফনের জন্য প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০টি ম্যাসেজ আসছে তাদের কাছে। অথচ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ম্যাসেজ আসত প্রতিদিন তিনটা বা চারটা।

মৃত্যু বাড়ার কারণ কী?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনায় মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ চিন্তা-ভাবনা করে বলতে হবে। কেউ বলছেন, অক্সিজেনের অভাব, কেউ বলছেন চিকিৎসার অভাব। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ কিনা সেটিও দেখার আছে। তবে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতে হবে।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসার অভাব, আইসিইউ শয্যার সংকট ও অক্সিজেনের অভাবে করোনায় মৃত্যু বাড়ছে। দেশের ৩৬ জেলায় এখনো পর্যন্ত করোনার সুচিকিৎসা করা যাচ্ছে না। বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরা অনেক সময় পেয়েছি। কিন্তু চিকিৎসাসেবার সক্ষমতা বাড়াতে পারিনি। তিনি বলেন, করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট যখন শুরু হলেছিল, তখন তা লুকানো উচিত হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, করোনায় মৃত্যু বৃদ্ধির অন্যতম কারণ রোগীদের সচেতন না হওয়া। বিলম্বে রোগীরা হাসপাতালে যায়, পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতায় রোগী মারা যায়। তিনি বলেন, করোনার কোনো উপসর্গ দেখা দিলেই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ড. সমীর সাহা বলেন, করোনায় মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ নতুন ভ্যারিয়েন্ট কি না সেই ব্যাপারে গবেষণা চলছে। বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর ফুসফুস দ্রুত ড্যামেজ করে দিচ্ছে। গবেষক ডা. সেজুতি সাহা সচেতনতামূলক একটি বক্তব্য দিয়েছেন। সেটি হলো, ‘ভ্যারিয়েন্ট যেটাই হোক, মাস্কে সে ধরা পড়বেই। মাস্ক পরুন। মুখ আর নাক ঢাকুন। নিজে বাঁচুন, অন্যদের বাঁচতে দিন।’

মোট মৃত্যু ১০ হাজার ৮১ জন

দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর হু হু করে মৃত্যু বাড়ায় গত ১৫ দিনেই দেশে ১ হাজার রোগী মারা গেছেন। গত বছর মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর বাংলাদেশে হাজার মৃত্যু ঘটতে এটাই সবচেয়ে কম সময়। গত বুধবার ৯৬ জন এবং গতকাল ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮১ জন। সংক্রমণের বিস্তার রোধে কঠোর লকডাউনের মধ্যে দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ১৯২ রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭ হাজার ৩৬২ জন। এক দিনে ৫ হাজার ৯১৫ জনের সেরে ওঠার তথ্যও জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে। সব মিলিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২১৪ জন।

দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। বছরের শেষ দিকে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এলেও সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর এখন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। গত ৩১ মার্চ ৫২ জনের মৃত্যুর পর থেকে দৈনিক মৃত্যু কখনোই ৫০-এর নিচে নামেনি। এর মধ্যে বুধবার এক দিনে সর্বাধিক ৯৬ জনের মৃত্যু ঘটে। প্রথম মৃত্যুর আড়াই মাস পর গত বছরের ১০ জুন মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়েছিল। এরপর ৫ জুলাই ২ হাজার, ২৮ জুলাই ৩ হাজার, ২৫ আগস্ট ৪ হাজার, ২২ সেপ্টেম্বর ৫ হাজার ছাড়ায় মৃতের সংখ্যা। এরপর কমে আসে মৃত্যু বাড়ার গতি। ৪ নভেম্বর ৬ হাজার, ১২ ডিসেম্বর ৭ হাজারের ঘর ছাড়ায় মৃত্যুর সংখ্যা। এ বছরের ২৩ জানুয়ারি ৮ হাজার এবং ৩১ মার্চ মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়েছিল। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত কয়েক দিন ধরেই দিনে ৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়ে আসছিল। এর মধ্যে গত ৭ এপ্রিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। গত দুই দিনে করোনায় আক্রান্ত হিসাবে শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ৩৭৭ জন।

গত বছরের জুন, জুলাই ও আগস্টে টানা তিন মাসে হাজারের বেশি মৃত্যু দেখেছিল বাংলাদেশ। পরে তা কমতে কমতে গত ফেব্রুয়ারিতে এক মাসে মৃত্যু ২৮১ জনে নেমে এসেছিল; কিন্তু এবার এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনেই হাজার মৃত্যুর তথ্য এলো, যখন সংক্রমণের তীব্রতা বাড়ায় ‘কঠোর’ লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে বিশ্বে অঞ্চলভিত্তিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়; যদিও এ সময়ে আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলে মৃত্যু কমেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পর এখন সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বাড়ছে বাংলাদেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, মৃত্যুর সংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৩৮তম অবস্থানে রয়েছে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি