শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বাড়ছে গ্রামে

আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২১, ০৫:২১

দেশে করোনা সংক্রমণ এখন সর্বোচ্চ চূড়ায়। সারা দেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মৃত্যু ও সংক্রমণের প্রতিযোগিতা চলছে। এক দিন মৃত্যু বেশি তো এক দিন সংক্রমণ। দুই পর্যায়েই চলতি মাসে একাধিকবার চলেছে রেকর্ড ভাঙাগড়া। চলতি জুলাই মাসের ২৩ দিনে আক্রান্ত ও মৃত্যু মহামারির দেড় বছরে আগের সব মাসের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ২৩ দিনে ২ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৬ জন আক্রান্ত এবং ৪ হাজার ৩৪৭ জন মারা গেছেন। সরকারি হিসাবেই প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এর বাইরেও সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু।

গ্রামগঞ্জে এ সংখ্যা বেশি। দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে কেউ না কেউ সর্দি, জ্বর-কাশি ও গলায় ব্যথায় আক্রান্ত। এদের বেশির ভাগই নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া সব এলাকায় পরীক্ষা করানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই। তাই ঘরে বসেই প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন তারা। যাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো তারা হয়তো কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে না। সর্দি-কাশি-জ্বর শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যাচ্ছেন বাড়িতেই। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়ায় বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে সারা দেশে অনেক গ্রামে সপ্তাহে গড়ে চার থেকে পাঁচ জন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন। ইত্তেফাকের স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ তথ্য জানা গেছে।

খুলনার চার হাসপাতালে আরও ২৪ জনের মৃত্যু

ডেলটার সংক্রমণ নগর ছাড়িয়ে গ্রামে পৌঁছে যাওয়া এবং আক্রান্ত কম বয়সিদের মৃত্যু বেড়ে যাওয়া বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, গত বছরে সংক্রমণ শুধু ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে ছিল। এবার সারা দেশে গ্রাম পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়েছে ব্যাপক আকারে। এদিকে দেশে গত চার দিনে ২৯ হাজার ২৫৪ জনের দেহে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। একই সময়ে করোনায় মারা গেছে ৭২৬ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ১৬৬ জনের মৃত্যু ও ৬ হাজার ৩৬৪ জনের শরীরে নতুন করে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংক্রমণ ও মৃত্যু বিচারে গত এপ্রিলের পর ভয়াবহ মাস ছিল জুন। চলতি জুলাই মাস শেষ হতে এখনো সাত দিন বাকি। এখন জুলাই মাসই ভয়াবহতম মাসে পরিণত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জুন মাসে ৯৮ হাজার ৩৩০ জন এবং জুলাই মাসে ৯২ হাজার ১৭৮ জনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। এ বছর এপ্রিলে রেকর্ড ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৭ জন, জুনে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। আর জুলাইয়ের ২৩ তারিখ পর্যন্তই ২ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৬ জন শনাক্তের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছে সাড়ে ১০ হাজার জন। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ রোগীদের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও। গত বছর জুনে ১ হাজার ১৯৭ জন এবং জুলাইয়ে ১ হাজার ২৬৪ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু এ বছরের এপ্রিলে ২ হাজার ৪০৪ জনের পর জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জনের মৃত্যু হয়। মৃতের সংখ্যার ঊর্ধ্বগতিতে জুলাইয়ের ২৩ দিনেই ৪ হাজার ৩৪৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে।

গ্রামাঞ্চলে করোনা মোকাবিলায় সরকার সারা দেশে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করেছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করবে। গ্রামে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সহযোগিতা করা, কারোর শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দিলে তাকে পরীক্ষা করানো, আইসোলেশনে রাখাসহ সার্বিক অবস্থা দেখভাল করবে এই কমিটি। কিন্তু কমিটি কাজ করছে কি না, তা মনিটরিং করা হচ্ছে না। ওয়ার্ড পর্যায়ে হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পর্যায়ে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ ও উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবার যে বেহাল দশা সেটিও যেন দেখার কেউ নেই। সব মিলিয়ে গ্রামে করোনা পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় মৃত্যু কমেছে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, উপসর্গ দেখা দিলেও গ্রামের মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে চায় না। একই সঙ্গে চিকিত্সায় নিতে চায় না। গ্রামের মানুষকে করোনাসহ স্বাস্থ্য সচেতন করতে সরকার জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে কমিটি গঠন করেছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ থেকে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে চিঠি পাঠানো হয়েছে। উপসর্গ হলে চিকিত্সা নেওয়া, ঘরে থাকা, আইসোলেশনে রাখা এসব কাজে সহযোগিতা করবে উল্লিখিত কমিটি। তবে বর্তমান সময়টা সর্দি-কাশির মৌসুম। এ কারণে জ্বর-সর্দি-কাশি হলে গ্রামের মানুষ মৌসুমি রোগ মনে করে চিকিত্সা নিতে চাচ্ছে না। এসব উপসর্গ যে করোনার কারণেও হতে পারে সেটা গ্রামের অনেক মানুষ জানেন না। শারীরিক অবস্থা জটিল হলে চিকিত্সকের কাছে যাচ্ছে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। এছাড়া গ্রামের মানুষ মাস্ক পরে না, স্বাস্থ্যবিধি মানেন না। জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির এই ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর তদন্ত হওয়া উচিত। সরকারের আইনেও আছে, প্রতিটি মৃত্যুর কারণ জানানো। মৃত্যুর কারণ করোনায় জানা গেলে গ্রামের মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকে যাবে। তখন গ্রামের মানুষ সচেতন হবে, মাস্ক পরবে। শহরের মানুষ টিকা নিয়েছে। আর গ্রামের ৮০ ভাগ মানুষ টিকা নেয়নি। তারা পরীক্ষা করাতে ও টিকা নিতে তেমন আগ্রহী নয়। তবে এখন টিকা নেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। গ্রামের বৃদ্ধদের টিকা নিতে উত্সাহিত করতে হবে। টিকা নেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনায় মারা যাওয়া ৯০ ভাগ রোগী টিকা নেয়নি। টিকা নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি