শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:১০

মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্ব এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি। ভাইরাসটির দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ বেড়ে নতুন রোগীর সংখ্যা বিশ্ব জুড়ে হুহু করে বাড়ছে। এ সময় সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ে সচেতন মহলে আশঙ্কা সৃষ্টি হলেও বেশির ভাগ মানুষ কম গুরুত্ব দিচ্ছেন। লম্বা লকডাউন উঠে যেতেই অনেকেই বেড়াতে গিয়েছেন। এ কারণে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। আমাদের দেশেও একই অবস্থা। করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। অথচ এর মধ্যেও শহর ও গ্রামে মানুষ নির্ভয়ে চলাফেরা করছে, অনেকেই অপ্রয়োজনে এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্কুল না খুললেও শিশুদের নিয়ে মা-বাবারা বাইরে যাচ্ছেন।
 
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসের মিউটেশন (পরিবর্তন) ঘটে। স্প্যানিশ ফ্লুর বেলায় দ্বিতীয় সংক্রমণ ঢেউয়ে পরিবর্তিত ভাইরাসের শক্তি ছিল বেশি। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে স্প্যানিশ ফ্লুর মোট তিনটি ঢেউ দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউটা ছিল প্রথমটির তুলনায় মারাত্মক। তাই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত বসে থাকার কোনো উপায় নেই। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণের হার বাড়ছে। করোনার নতুন ভাইরাসের প্রকোপও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। যা আগের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি শক্তিশালী বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনার পরিবর্তিত ভাইরাস অনেক শক্তিশালী হয়ে সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা যাচ্ছে না। যেহেতু টিকা এখনো আসেনি, তাই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতি। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে আগের মতো চলছে, তার মানে এই নয় যে, করোনা সংক্রমণ শেষ হয়ে গেছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে, জীবন-জীবিকার কারণে সব খুলে দেওয়া হয়েছে, মহামারি শেষ হয়ে গেছে বলে নয়। এখনো বেড়ানো, উত্সব, সামাজিকতা, জনসমাগম করার মতো স্বাভাবিকতা আসেনি—এ কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। অনেকেই বলছেন, মৃত্যুহার কমে গেছে। কিন্তু তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি বা এমন কেউ যার ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, কিডনি রোগ বা জটিল সমস্যা আছে তাদের সচেতন থাকতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, মানুষ যেভাবে বাঁচতে ভালোবাসে, করোনার তা পছন্দ। সাধারণ মানুষ যত একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করবেন, বেড়াতে যাবেন, আরো বেশি লোকের সঙ্গে মিশবেন, করোনারও ছড়াতে তত সুবিধা হবে। এ বছরটা তাই সবাইকে স্বাভাবিক জীবনযাপন পরিত্যাগ করতেই হবে। টিকা না দেওয়া এবং করোনার প্রকোপ না কমে যাওয়া পর্যন্ত নিয়ম মেনে চলতেই হবে। কারণ করোনা যায়নি এবং কখন যাবে একথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।

সারা বিশ্বের মতো দেশেও করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এ ভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে নেই কোনো ভীতি-উদ্বেগ। সরকার ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ ঘোষণা করেছে, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার প্রচারণা চালাচ্ছে। অথচ সেদিকে কারোই ভ্রুক্ষেপ নেই। গণপরিবহন, হাটবাজার, বিপণিবিতান, মার্কেট, লঞ্চ-স্টিমার কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। মাস্ক পরতে মানুষকে বাধ্য করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নেমেছে, তবুও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু মাস্ক পরা বা হাত ধোয়ার মতো কাজগুলো করা অনেক জরুরি। বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ, বাতাসে আর্দ্রতা খুব বেশি। এ কারণেও অনেকেই মাস্ক পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। কিন্তু মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে মানুষ যেন রিলাক্স হয়ে গেছে। কেউ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছেন না। এ কারণে সংক্রমণ বাড়ছে। মানুষ সচেতন না হলে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে।

শীতে শ্বাসতন্ত্রের রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। সে সময় এমনিতেই বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের নিউমোনিয়া, ঠান্ডা, জ্বর-কাশি বেশি হয়। নিউমোনিয়ার মতো রোগ বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এসব রোগ হলে শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়। এ অবস্থায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে জটিলতা বেড়ে যায়। শীতে মানুষ ঘরেও বেশি থাকে। আর বদ্ধ জায়গায় ভাইরাস ছড়ায়ও বেশি। এ পরিস্থিতিতে করোনা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের কারণে মানুষের সর্দি-কাশি, অ্যাজমা (হাঁপানি) বাড়ে, ব্রংকাইটিস বাড়ে। সিজন চেঞ্জের জন্য কিছু ভাইরাল জ্বর হয়। টনসিল ফুলে যাওয়া, সাইনোসাইটিসের কারণে নানা রোগ দেখা দেয়। করোনার কারণে এই রোগীরা আক্রান্ত হলে তাদের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে পারে। তাই সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিত্সক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, শীতে করোনা বাড়ে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তবে যেহেতু শীতকালে বদ্ধঘরে থাকা হয়। অফিস-আদালতে বদ্ধঘরে অনেক মানুষ থাকে। তাই এ সময় করোনা দ্রুত ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপরে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মাস্ক পরলে শতকরা ৮০ ভাগ করোনা থেকে নিরাপদে থাকা যায়। এ জন্যই ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ বাস্তবায়ন করতে হবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে শীতে করোনা সংক্রমণের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। শিশুরা সতর্ক থাকতে পারে না বলে বাহকে পরিণত হয়। নিজেদের উপসর্গ না হলেও পরিবারে বয়স্কদের সংক্রমিত করছে তারা। দীর্ঘ সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় ঘরে থাকতে থাকতে তারা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। তাই খেলার জন্য সাইকেল নিয়ে ঘুরতে হলেও তারা বিকালে বাসার বাইরে যাচ্ছে। যা তাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

করোনা থেকে বাঁচতে যেভাবে প্রস্তুতি নেবেন

অপ্রয়োজনে বাইরে যাবেন না। কাজ শেষে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসুন। আপনার পরিবারের কাছে আপনি সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি। তাই অকারণে ঝুঁকি নেবেন না। বাইরে গেলে সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনে চলুন। যথাসম্ভব দূরত্ব মেনে চলুন। ঘরের বাইরে অবশ্যই মুখে মাস্ক পরবেন। মাস্ক খুলবেন না। বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস অব্যাহত রাখুন। হাঁচি-কাশির নিয়মগুলো মেনে চলুন। অসুস্থবোধ করলে, জ্বর, কাশি বা গলাব্যথা, স্বাদহীনতা দেখা দিলে উপসর্গ যত মৃদুই হোক, নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা রাখুন। পরীক্ষা না করা বা চিকিত্সকের পরামর্শ না নেওয়া পর্যন্ত সবার সঙ্গে মিশবেন না। বাড়ির সবার কাছ থেকেও দূরে থাকুন। এখন অনেকেরই মৃদু উপসর্গ হচ্ছে আর তা নিয়েই সবাই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অযথা বীরত্ব দেখাবেন না। শীতে আমাদের ঘোরাঘুরি, উত্সব, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। কিন্তু এবার শীতে যে কোনো রকম জনসমাগম, উত্সব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। উত্সব অনুষ্ঠান করতে হলে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করুন। শিশুদের নিয়ে অকারণে বাইরে যাবেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ। তাই তাদের নিয়ে সমুদ্রসৈকতে, রিসোর্টে বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরে বেড়ানো যাবে না। প্রয়োজনে ফ্লু বা নিউমোনিয়ার টিকা নিন।

ইত্তেফাক/কেকে