নোভেল করোনা ভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ এবং এই মহামারির জীবনসংহারী আগ্রাসন এবং আর্থসামাজিক বিরূপ অভিঘাত মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও অঙ্গীকারবদ্ধ নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য সফল দেশ। এখন করোনা প্রতিষেধক টিকা প্রদানেও সুব্যবস্থা করে উদাহরণস্থানীয় হয়ে উঠেছে। আমি এবং আমার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জাহেদা আহমদ ৯ ফেব্রুয়ারি টিকা দিয়েছি। আমরা লক্ষ্য করেছি, টিকাদানব্যবস্থা সুশৃঙ্খল। টিকা দেওয়ার পর আমাদের কারো মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নি। দেশে টিকা প্রাপ্তি এবং টিকা প্রদানব্যবস্থা সম্বন্ধে পরে আরো কিছু কথা বলব। তার আগে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব এবং কীভাবে তার মোকাবিলা করা হলো সে সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চাই।
নোভেল করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয় চীনের উহানে। বিশ্বে এই করোনার প্রথম সংক্রমণ সেখানে শনাক্ত করা হয় ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর এবং ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই এর অভূতপূর্ব সংক্রমণগতি ও মারণক্ষমতা ধরা পড়তে থাকে। বাংলাদেশে করোনাকাল শুরু হয় ৮ মার্চ ২০২০। ঐদিন প্রথম তিন জনকে করোনা আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়।
এই মহামারির প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করার প্রস্তুতি উন্নত, উন্নয়নশীল—কোনো দেশেরই ছিল না। কেননা এটি হঠাত্ করেই আবির্ভূত হয় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা বিশ্বে।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর মানুষের জীবন রক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের অসংখ্য মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে প্রথমদিকে শ্লথ গতিতে শুরু করা হলেও শিগিগর তত্পরতা বাড়ানো হয় এবং সংক্রমণ পরীক্ষা এবং আক্রান্তদের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দ্রুত উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়।
পাশাপাশি, ৬৬ দিন সারা দেশ লকডাউনে (সাধারণ ছুটিতে) থাকার পর বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুনর্জাগরণের প্রয়োজনে আস্তে আস্তে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রয়োজনীয় সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে প্যাকেজটির পরিমাণ ছিল জাতীয় উৎপাদের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫ শতাংশ, পরে উন্নীত করা হয় ৩ দশমিক ৬ শতাংশে এবং সর্বশেষে ৪ দশমিক ৩ শতাংশে। এটা এখন দৃশ্যমান যে—অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কত দ্রুত উল্লেখযোগ্যভাবে সার্বিক অগ্রগতি হবে সেটা আন্তর্জাতিক মন্দার গভীরতা ও তা কতদিন চলবে তার উপরও নির্ভর করবে। বিশেষ করে, যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যসম্পর্ক রয়েছে সে সব দেশে তারও প্রভাব থাকবে। দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে চিহ্নিত করে এক্ষেত্রে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন আরো বেশি নিশ্চয়ই হতে পারত—যদি ঘোষিত নীতি, সহায়তা ও প্রণোদনা প্যাকেজ এবং অন্যান্য কর্মসূচি আরো কার্যকরভাবে এবং যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা হতো। ঘাটতির একটি উদাহরণ: কুটির শিল্প ও অতিক্ষুদ্র অসংখ্য উদ্যোগ। যেখানে সংশ্লিষ্ট আছে প্রায় ৩ কোটি মানুষ যারা এখনো প্রণোদনা পায়নি। এসব মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে না যেতে পারলে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের ভিত নড়বড় থেকে যাবে এবং অর্থনীতির এগিয়ে চলা গতি পাবে না।
তবে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, পৃথিবীতে মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ করোনাকালে এবং এই মহামারির অভিঘাত থেকে উত্তরণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মুনশিয়ানা দেখিয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অবশ্যই তা সম্ভবপর হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনকল্যাণকামী বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অনুকূল পারিপার্শ্বিকতা তৈরি হওয়া এবং সেই সুযোগ গ্রহণ করে বিভিন্ন খাতে সব পর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা গ্রহণ ও পরিশ্রম করার ফলে।
বাংলাদেশে করোনা মহামারি প্রথম ঢেউয়ে এক দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত করা হয় ২০২০ সালের ২৫ জুন। ৩ হাজার ৯৪৬ জন। এক দিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যু ঘটে ২০২০ সালের ৩০ জুন। তারপর সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষণীয়; কিন্তু নভেম্বরে শুরু হয় দ্বিতীয় ঢেউ। তবে দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউ থেকে দুর্বল ছিল। সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণ ২ হাজার ৫২৫ (৩০ নভেম্বর ২০২০) এবং সর্বোচ্চ দৈনিক মৃত্যু ৪০ জন (২৫ ডিসেম্বর ২০২৯)। ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ দিক থেকে উভয় সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসে বিগত কয়েক দিন ধরে (১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) গড়ে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৩০০-৪০০ এবং ১০-১২ জন। খুবই উল্লেখযোগ্য উন্নতি।
বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ আবারও বাড়তে পারে। এবং তা মারাত্মকরূপে আবির্ভূত হতে পারে। অনেক দেশে দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউ থেকে অনেক বেশি বিপত্সংকুল হচ্ছে।
তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা সে সব দেশে রয়েছে। কাজেই এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে টিকা নিতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে—কোনো দেশের ৭০-৭৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে সমগ্র জাতি করোনা-প্রতিরোধক্ষম হতে হলে, দেশে হার্ড ইমিউনিটি নিশ্চিত হতে হলে। বিভিন্ন উন্নত দেশে টিকা দেওয়া শুরু হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রথম যুক্তরাজ্যে ৮ ডিসেম্বর এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ ডিসেম্বর।
বাংলাদেশ কবে করোনা টিকা পাবে এবং টিকা দেওয়া শুরু করবে তা নিয়ে নানা জল্পনা ছিল। যুক্তরাজ্যে করোনা প্রতিষেধক টিকা দেওয়া আরম্ভ করার দেড় মাসের মাথায় বাংলাদেশে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুতকৃত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসতে শুরু করে। ২০২১-এর ২১ জানুয়ারি প্রথমে আসে ভারত সরকারের উপহারস্বরূপ ২০ লাখ টিকা এবং বাংলাদেশের ক্রয় করা ৩ কোটি টিকা থেকে প্রথম কিস্তির ৫০ লাখ আসে তার চার দিন পর অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি।
কেমন করে তা সম্ভব হলো? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে যেসব দেশ ও কোম্পানি টিকা আবিষ্কারে সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয় যাতে টিকা আবিষ্কৃত হলেই বাংলাদেশ দ্রুত টিকা সংগ্রহ করতে পারে। এই ধারাবাহিকতায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা উত্পাদনকারী ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ৩ কোটি টিকা সরবরাহ করার জন্য ক্রয়চুক্তি করা হয়। দেখা গেল, অনেকে বলতে শুরু করলেন ভারত থেকে টিকা আসবে না, আর এলেও সময়মতো আসবে না অথবা অপরীক্ষিত স্বাস্থ্যহানিকর কোনো টিকা আসবে। সিরাম ইনস্টিটিউটের পরিচালকের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আরো কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন চুক্তিকৃত টিকা আসবে না এবং এলেও কয়েক মাস বা আরো দীর্ঘ সময় লাগবে। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও তারা হইচই চালিয়ে যেতে থাকেন। এছাড়াও নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য তারা দিতে থাকেন। টিকা যথাসময়ে দেশে পৌঁছার পরই এ বিষয়ে তাদের মুখ বন্ধ হয়। নতুন নেতিবাচক বক্তব্য শুরু হয়। টিকা প্রদানে অব্যবস্থা হবে এবং উপযুক্ত সবাই ঠিকমতো টিকা নেওয়ার সুযোগ পাবে না, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে ইত্যাদি। দেশের সব মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কি আমরা চিন্তাচেতনা ও বক্তব্যে ইতিবাচক হতে পারি না?
সিরাম ইনস্টিটিউট ছাড়াও পরবর্তীকালে অন্যান্য উত্স থেকে সরাসরি অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আরো টিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানা যায়। আমরা আশা করতে পারি, এই কর্মসূচিও সফল হবে।
আগেই বলেছি সুশৃঙ্খলভাবে টিকা দেওয়া হচ্ছে। আমি টিকা নিয়েছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে তো বটেই, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও একইভাবে সুন্দর ব্যবস্থায় টিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দিকে কিছুটা অনীহা দেখা গেলেও আস্তে আস্তে মানুষ টিকা নিতে উৎসাহিত হয়ে উঠছে। মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইনে নিবন্ধন যাতে সুচারুভাবে চলতে থাকে এবং নিবন্ধিতরা যাতে যথাযথভাবে তারিখ পান সেদিকে নজর রাখতে হবে।
শেষ করার আগে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। টিকা নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমাপ্ত হয়ে যায়, এমনিতে ইনেজকশন দেওয়ার মতোই। আমার এবং আমার স্ত্রীর কোনো ধরনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি টিকা নেই ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার সময়। তারপর সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ২টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টা ধরে একটি ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করি এবং বেশ লম্ব্বা বক্তব্য রাখি। বিকাল ৪টার সময় অনলাইনে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাত্কার দেই এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে এক ঘণ্টার মতো ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিবেশ অর্থনীতির নতুন স্নাতকোত্তর ব্যাচকে স্বাগত জানানোর অনলাইন অনুষ্ঠানে যুক্ত হই এবং বেশ কিছুক্ষণ বক্তব্য রাখি। সুতরাং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোনো চিন্তা না করে সবাই টিকা নিতে পারেন বলে আমি মনে করি। টিকা নিবেন নিজ স্বার্থে, দশের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
ইত্তেফাক/কেকে