শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাজনৈতিক পরিচয়ে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করত আসামিরা

আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০১:৩৬

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যায় ২৫ জনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। একক কোনো কারণে নয়, বেশ কিছু কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং ১৪ জনের সম্পৃক্ততা দেখানো হয়েছে চার্জশিটে। দণ্ডবিধির ৩০২/১০৯/১১৪/৩৪ ধারায় আসামিদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি ৪ জন এখনো পলাতক রয়েছে।

আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে। এদের মধ্যে ৮ জন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের পদধারী নেতা। এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ৮ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ১৩ জনের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই চার্জশিট জমা দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ হিসেবে একক কোনো কারণ খুঁজে পায়নি পুলিশ। অনেকগুলো কারণেই আবরার ফাহাদকে পেটানো হয়। পাশাপাশি হত্যায় জড়িতরা সব সময় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করত। এদের সবাই উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত ছিল। আগে থেকেই তারা নানা কারণে আবরার ফাহাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। একজনকে মেরে অন্যজনকে শিক্ষা দিতে কিংবা জুনিয়রদের মধ্যে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে তারা (আসামিরা) দীর্ঘদিন ধরে র্যাগিংয়ের নামে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। যার আচরণ অপছন্দ হতো, তাদেরই ডেকে এনে নির্যাতন করা হতো।

ঢাকার আদালতে চার্জশিট প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হেমায়েত উদ্দিন খান সাংবাদিকদের জানান, আবরার হত্যা মামলার আলামত হিসেবে পাঁচটি ক্রিকেটের স্টাম্প জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি স্টাম্প ভাঙা। আবরারকে পেটানোর সময় এসব স্টাম্প ভেঙে যায়। এছাড়া স্কিপিং রশি, আবরার ফাহাদের রক্তমাখা জামাকাপড়, আসামিদের মেসেঞ্জারের কথোপকথন এবং বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ দেখানো হয়েছে।

গত ৬ অক্টোবর রবিবার রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হল থেকে তড়িত্ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন।

পুলিশ যা বলছে :গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আবরার ফাহাদকে মারধরের সঙ্গে সরাসরি ১১ জন জড়িত ছিলেন। বাকিরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ঘটনার পরিকল্পনা ও নির্দেশনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত ৩১ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ঘটনার দিন রাত ১০টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত আবরারকে পেটানো হয়। রাত আড়াইটার দিকে বুয়েটের ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরেকটু মনিটরিং করলে এ ঘটনা এড়ানো যেত। তদন্তে আমরা তাদের ব্যর্থতা দেখেছি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে তাদের গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা পুলিশের বিষয় নয়।’

মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় মোট ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আমরা আদালতে চার্জশিট দিচ্ছি। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের বাইরে ঘটনার তথ্য-প্রমাণে আরো ৬ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৬ জন এবং এজাহারবহির্ভূত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, রাত তিনটার দিকে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়, শিবির সন্দেহে একজনকে আটক করা হয়েছে। এ সময় পুলিশের টহল টিম হলের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু পরে জানানো হয়, সেখানে কিছু হয়নি। তিনটার আগে পুলিশ এ বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি।

যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট :মামলার চার্জশিটভুক্ত ২৫ আসামির সবাই বুয়েটের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন হলেন মেহেদী হাসান রাসেল, মুহতাসিম ফুয়াদ, মো. অনিক সরকার ওরফে অপু, মো. মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মাজেদুর রহমান ওরফে মাজেদ, মো. মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাক্্কারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, আকাশ হোসেন, মো. শামীম বিল্লাহ, মো. সাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত, মো. মোয়াজ ওরফে মোয়াজ আবু হোরায়রা, মুনতাসির আল জেমি, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মো. মোর্শেদ ওরফে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম। এর মধ্যে শেষের তিন জন পলাতক।

এছাড়া আবরার হত্যায় এজহার নামীয় আসামির বাইরে আরো ছয় জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে গোয়েন্দারা। এরা হলেন—অমিত সাহা, মো. মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, এস এম মাহমুদ সেতু, সামছুল আরেফিন রাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না ও মুজতবা রাফিদ। এর মধ্যে মুজতবা রাফিদ পলাতক রয়েছেন।

সরাসরি জড়িত ১১ জন : আবরারকে হত্যায় সরাসরি যে ১১ জন জড়িত ছিলেন, তারা হলেন—মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, মো. অনিক সরকার ওরফে অপু, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মুজাহিদুর রহমান ওরফে মুজাহিদ, মো. শামীম বিল্লাহ, মো. সাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত, মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম ওরফে তানভীর।

চার্জশিটে যা বলা হয়েছে : প্রতিবেদনে বলা হয়, আবরার শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এই সন্দেহেই তাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেয় বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ঘটনার আগে তারা একটি মিটিংও করে। এর আগে বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে আবরারকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দেয়। এতে অনেকেই সায় দেয়। তারপর আবরারকে গত ৬ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টার দিকে শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে অমিত সাহার ২০১১ নম্বর কক্ষে এনে মারধর করা হয়। তাকে কিল-ঘুষি মেরে, স্কিপিং দড়ি দিয়ে ও ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটায় হত্যাকারীরা। তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে পেটানো হয়। পানি পানি বলে চিত্কার করলেও তাকে পানি খেতে দেওয়া হয়নি। আবরারকে পেটানোর একপর্যায়ে তিনি কয়েকবার বমি করেন। কিন্তু তার চিকিত্সার ব্যবস্থা করেনি কেউ। একপর্যায়ে গভীর রাতে আবরার মারা যাওয়ার পর তাকে ধরাধরি করে দোতলার সিঁড়ির ওপর ফেলে রাখে হত্যাকারীরা।
 
দুই আসামির শিবির সংশ্লিষ্টতা: চার্জশিটে বলা হয়েছে, মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্তর পিতামহ মৃত মমতাজ উদ্দিন সরদার ওরফে মুনতাজ ডাক্তার রাজশাহীতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তার এক চাচা ইমরান স্থানীয় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আরেক আসামি হোসেন মোহাম্মদ তোহা খুলনায় থাকাকালীন শিবিরের সদস্যদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। তিনি শিবিরের সমর্থক ছিলেন। তার পিতা আবুল হোসেন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সমর্থক বলে জানা গেছে।

ইত্তেফাক/বিএএফ