শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সাবেক এমপির জামিন প্রসঙ্গে

জজ প্রত্যাহার নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা

আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২০, ০৬:৪৫

সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল দম্পতির জামিন ইস্যুতে পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নানকে প্রত্যাহারের ঘটনা বুধবার সারাদেশে আলোচনায় ছিল। জেলা জজকে তার দায়িত্ব থেকে তাত্ক্ষণিক প্রত্যাহারের আদেশ কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘সাবেক জেলা জজ আব্দুল মান্নান অত্যন্ত অশালীন ও রূঢ় ব্যবহার করায় এবং উদভুত পরিস্থিতি প্রশমিত করতেই তাকে তাত্ক্ষণিক বদলি করা হয়েছে’।

এদিকে, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল জামিন পাওয়ার পরদিন বুধবার সংবাদ সম্মেলনে একজন মন্ত্রীর (যিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য) বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন। তবে উক্ত মন্ত্রী তার বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও অসত্য’ বলে দাবি করেছেন। 

অন্যদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিচারবিভাগ যে স্বাধীন নয় সেটা আরেকবার উলঙ্গভাবে প্রমাণিত হল। এছাড়া আইনমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবির পাশাপাশি এই ঘটনা হাইকোর্টের একজন বিচারপতির অধীনে তদন্তের কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার এম মাহবুবউদ্দিন খোকন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, একজন জজ জামিন আবেদন খারিজ করার পর একই জায়গায় আরেকজনকে বসিয়ে জামিন দেওয়ার নজির আগে দেখিনি।

প্রসঙ্গত, আউয়াল পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার স্ত্রী লায়লা পারভীন জেলা মহিলা লীগের সভানেত্রী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত তিনটি মামলায় আউয়াল দম্পতি মঙ্গলবার পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নানের আদালতে জামিন চাইলে তিনি আবেদন নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এতে আউয়ালের ক্ষুব্ধ সমর্থকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এই অবস্থায় জেলা জজ আব্দুল মান্নানকে তাত্ক্ষণিক বদলি করে আইন মন্ত্রণালয়। এরপর বিকালে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব নিয়ে বিচারক নাহিদ নাসরিন আউয়াল দম্পতিকে জামিন দেন।

দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব চেয়েছে হাইকোর্ট
পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নানকে তার দায়িত্ব থেকে তাত্ক্ষণিক প্রত্যাহারের আদেশের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে জারি করা রুলের দুই সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে সংশ্লিষ্টদের আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং একই বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) কে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারক প্রত্যাহারের ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল স্বতপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন। আগামী ১১ এপ্রিল এবিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য রাখা হয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম, ইউনূস আলী আকন্দ ও আবুল হাশিম। তারা আদালতে বলেন, যে প্রেক্ষাপটে একজন জেলা ও দায়রা জজকে বদলি করা হয়েছে সেটা বিচারবিভাগের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে।

এর আগে সকালে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে পত্রিকার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আইনজীবী মো. শিশির মনির। তখন আদালত বলেন, প্রধান বিচারপতি বিচারবিভাগের অভিভাবক, তিনি নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএ) কমিটির প্রধান। সবচাইতে ভালো হয় বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নজরে আনুন।

জজের আচরণ ছিল অশালীন ও রূঢ়, সিচুয়েশনটাকে প্রশমিত করতেই প্রত্যাহার : আইনমন্ত্রী
আউয়াল দম্পতির জামিন নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নান অত্যন্ত অশালীন ও রূঢ় ব্যবহার করায় তাকে তাত্ক্ষণিক বদলি করা হয়েছে। এই বদলি আইনের শাসনের ব্যত্যয় কিংবা বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ নয়। মন্ত্রী বলেন, পিরোজপুরে জেলা জজের কাছে পিরোজপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তার স্ত্রী দুর্নীতির মামলায় জামিত চাইতে গিয়েছিলেন। জামিন চাওয়ার সময় তার আইনজীবী এবং বারের সকল আইনজীবীর কাছ থেকে আমরা যে তথ্যাদি পেয়েছি, জেলা ও দায়রা জজ অত্যন্ত অশালীন এবং রূঢ় ব্যবহার করেন। সেই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায়, যেখানে বারের সকলে আদালত বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই অবস্থায় যখন এসব গণ্ডগোল চলছিল এবং রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে গিয়েছিল, সেটাকে কন্ট্রোল করার জন্য তাকে (জজ) ওখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ (তাত্ক্ষণিক বদলি) করে আদেশ দেওয়া হয়, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে।

জেলা জজের এই ব্যবহার করা সমীচীন হয়নি মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী বলেন, সিচুয়েশনটাকে প্রশমিত করতেই আউয়াল দম্পতিকে জামিন দেওয়া হয়েছে এবং এতে আইনের শাসনের ব্যত্যয় হয়নি।

তদন্ত না করেই বিচারককে দোষী বানিয়ে বদলি করা হল কেন- সেই প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপ না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে দোষি সাব্যস্ত করে ওই বিচারককে বদলি করা হয়নি।

এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও বিএনপি নেতা মাহবুব উদ্দিন খোকন আইনমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আনিসুল হক বলেন, ‘উনি তো অনেক কিছুই চাইতে পারেন। কিন্তু দুঃখের হচ্ছে, তথ্যাদি না জেনে আমাকে দোষারোপ করে তিনি অন্যায় করেছেন। এর থেকে বাড়লে আমি ব্যবস্থা নেব।’ এ ধরনের ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেনি- দুদকের আইনজীবীর এমন বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, ‘দুদকের আইনজীবীরা এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন কি-না, সেটা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।

এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আউয়ালের, অস্বীকার ওই মন্ত্রীর
ইত্তেফাকের পিরোজপুর অফিস জানায়, গতকাল দুপুরে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক এমপি আউয়াল তার বক্তব্যে দাবি করে বলেন, ‘আমার জামিন নামঞ্জুর করতে বিচারক আব্দুল মান্নানকে প্রভাবিত করেছেন একজন মন্ত্রী। তবে উক্ত মন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আউয়ালের আনীত সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অসত্য।

পিরোজপুরে আইনজীবী সমিতির সংবাদ সম্মেলন
ইত্তেফাকের পিরোজপুর অফিস জানায়, জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মান্নান পিরোজপুরের কর্মস্থল ত্যাগ না করায় আইনজীবীরা পূর্ব ঘোষিত আদালত বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। গতকাল বিকালে জেলা আইনজীবি সমিতি সংগঠনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা জজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে সখ্য ও বিভিন্ন অনৈতিক কাজের অভিযোগে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হক খান পান্না বলেন, জেলা জজ মো. আব্দুল মান্নান পিরোজপুর আদালতে যোগদানের পরপরই স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। যা কিনা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভুত।

বিচারবিভাগ যে স্বাধীন নয় সেটা আরেকবার প্রমাণিত : ফখরুল
গতকাল সকালে আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিতে নয়াপল্টনের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, পিরোজপুরের ঘটনাই প্রমাণ করে দেশের বিচারবিভাগ সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা যে কথাটা সবসময় বলছি, বিচারবিভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার, এটাই তার প্রমাণ। কারণ পিরোজপুর আওয়ামী লীগের সভাপতিকে যখন দুদকের দায়ের করা দুর্নীতির মামলায় ভেতরে বা কাস্টডিতে নিতে বলেছেন আদালত, তখন যে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে, বাধ্য করা হয়েছে আদালতকে কয়েক ঘণ্টা পরে জামিন দিতে। এই ঘটনা প্রমাণ করে এদেশে আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। এখানে বিচারবিভাগ যে স্বাধীন নয় সেটা আরেকবার উলঙ্গভাবে প্রমাণিত হল।