শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আশার বিপরীতে হতাশার চিত্র বেশি

আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০৭:৩৭

দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তির নজির সৃষ্টি করে চলছে দেশের বিচার বিভাগ। হত্যা, ধর্ষণ ও মাদকের বেশ কয়েকটি মামলা স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তি ও আসামির দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়ে এই নজির গড়েছেন বেশ কয়েক জন বিচারক। ফৌজদারি মামলা বিলম্বে নিষ্পত্তির যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন অনেক বিচারক। তারা বিচারপ্রার্থী জনগণকে দ্রুত বিচার পাইয়ে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তবে এই আশার বিপরীতে বিচারপ্রার্থী জনগণের হতাশার চিত্রই বেশি। কারণ অসংখ্য ফৌজদারি মামলা রয়েছে যেগুলোতে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে কিন্তু বিচার শেষ করা যাচ্ছে না। যথাসময়ে তদন্ত সম্পন্ন না করা, সাক্ষী হাজিরের ব্যর্থতায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর মামলার বিচার বিলম্বিত করতে আসামিপক্ষের অহেতুক সময়ক্ষেপণ তো রয়েছেই।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘটনা সংঘটনের পর মামলা দায়ের, দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে চার্জশিট দাখিল করলে বিচারকাজ শুরুর প্রক্রিয়াটা অনেকটাই এগিয়ে যায়। এরপর যথাসময়ে আদালতে সাক্ষী হাজির ও মুলতুবি ছাড়াই বিচারকাজ করা গেলে স্বল্প সময়ে যে কোনো মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের আট বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৮ লাখ ৬ হাজার। এর মধ্যে পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৭১ হাজার ৬৫৯টি। দীর্ঘ সময় ধরে বিচারাধীন এসব মামলার মধ্যে ঢাকা বিভাগেই ৮৪ হাজার, চট্টগ্রামে ৫৩ হাজার মামলা রয়েছে। এছাড়া দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৩১ হাজার ৫৩৯টি মামলা বিলম্ব বিচারের নজির সৃষ্টি করেছে। এছাড়া মাদকের ২৬ হাজার ১২৪টি, দায়রা মামলা ৫৪ হাজার, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা ২৯ হাজারটি। এগুলো পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন।

আশার চিত্র

কুষ্টিয়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের মামলার বিচার শেষ করা হয়েছে মাত্র তিন কার্যদিবসে। গত ১৭ নভেম্বর দেওয়া ঐ রায়ে মাদ্রাসা সুপার আব্দুল কাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুন্সি মো. মশিয়ার রহমান। চলতি বছরের ৪ অক্টোবর ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় ঐ দিনই গ্রেফতার এবং পরদিন দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আসামি। অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ১২ নভেম্বর চার্জ গঠন করা হয়। মাঝে দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ১৫ নভেম্বর ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। আসামির আত্মপক্ষ সমর্থন, বাদী-বিবাদী পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়।

বাগেরহাটের মোংলায় সাত বছর বয়সি এক শিশুকে ধর্ষণ মামলায় অভিযোগ গঠনের সাত কার্যদিবসের মধ্যে রায় ঘোষণা করেছে জেলা ও দায়রা জজ মো. নূরে আলম। গত ১৯ অক্টোবর দেওয়া ঐ রায়ে একমাত্র আসামি আব্দুল মান্নান সরকারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার বিচার শেষ হয়েছে ১৩ কার্যদিবসে। গত ১৯ নভেম্বর ঐ বিচারে আসামি মজনুকে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম কামরুন্নাহার।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রূপা খাতুনকে দল বেঁধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার শেষ করা হয় মাত্র ছয় মাসে। অভিযোগ গঠনের পর মাত্র ১৪ কার্যদিবসে মামলার বিচার শেষ করে রায় ঘোষণা করেন টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবুল মনসুর মিয়া। ঐ রায়ে বাসচালক ও চালকের সহকারীসহ চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইন সাময়িকী ঢাকা ল রিপোর্টস সম্পাদক অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ইত্তেফাককে বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে। যেন বিচারে কোনো ধরনের আবেগ কাজ না করে। যদি সেটা হয় তাহলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে। কাজেই বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের আবেগের ঊর্ধ্বে ওঠে বিচারকাজ করতে হবে।

হতাশার চিত্র

২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর খুলনার দৌলতপুরে তৃতীয় শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থী হালিমাকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। গত ১১ বছরেও এই মামলার বিচার শেষ করতে পারেনি খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা জেলার সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এক দশকে মাত্র ছয় জন সাক্ষীর সাক্ষ্য হয়েছে। অফিশিয়াল সাক্ষীরা না আসায় বিচার শেষ করা যাচ্ছে না।

২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে হত্যা করা হয়। এ মামলায় সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানাসহ প্রভাবশালীরা আসামি। মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর সাত বছর পেরিয়ে গেছে বিচার শেষ হয়নি।

২০১৫ সালের ২১ মে কুড়িল ফ্লাইওভারে এক তরুণী ধর্ষণের মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য না দেওয়ায় এ অচলাবস্থার সৃষ্টি।

বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার কর্তৃক কলেজছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই। দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেওয়া ঐ ঘটনায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১। অভিযোগ গঠন হলেও এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রাখা হয়েছে বলে জানান ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট নরেশ মুখার্জি। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, করোনার কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ছোটখাটো অপরাধে আমাদের দেশে প্লি-বার্গেইনিং পদ্ধতি জনপ্রিয় করা দরকার। এটা করা গেলে বিলম্বিত বিচারের নজির ও মামলা জট থেক বেরিয়ে আসা সম্ভব।

ইত্তেফাক/এএএম