শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সফটওয়্যারেই হচ্ছে ইংরেজি থেকে বাংলায় রায় রূপান্তর

আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:৪৭

বিচারপ্রার্থীর বোধগম্য ভাষায় রায় প্রকাশ চলছে। ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় রায় রূপান্তরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। সেই লক্ষ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে গঠন করা হয়েছে অনুবাদ সেল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সেল থেকে এই রায় রূপান্তরের কার্যক্রম চলছে। ভারতীয় হাইকমিশন ঐ সফটওয়্যারটি বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টকে প্রদান করেছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সফটওয়্যার উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে ১৯৬৭ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার ঘোষিত রায়টি অনুবাদ করা হয় বাংলা ভাষায়। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০টি রায় ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে।

এই সফটওয়্যার প্রসঙ্গে অনুুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘আমার ভাষা’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের ইংরেজি রায়সমূহ বাংলায় রূপান্তরিত হবে। পরে ঐ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে জনসাধারণের জন্য প্রচার করা হবে। এই অনুবাদ প্রকল্পের উদ্বোধন উচ্চ আদালত তথা আইন অঙ্গনে গণমানুষের প্রবেশাধিকারকে মসৃণতর করবে। এই কার্যক্রম দেশের বিচার বিভাগকে নিয়ে যাবে নতুন এক মাইলফলকে।

যেভাবে এলো সফটওয়্যার

গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় প্রদানের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছিলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। পরবর্তীকালে ভারতের প্রধান বিচারপতি শারদ আরবিন্দ ববডের’র আমন্ত্রণে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে যোগ দেন তিনি। সেখানে গিয়ে প্রধান বিচারপতি জানতে পারেন যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘সুভাস’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত সফটওয়্যার ব্যবহার করে ইংরেজিতে প্রদত্ত রায় বাংলাসহ নয়টি ভাষায় অনুবাদ করেছে। ভারত থেকে দেশে ফিরে প্রধান বিচারপতি প্রাক্তন ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশকে এই সফটওয়্যারটি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টকে সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। পরবর্তীকালে বর্তমান হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে গত অক্টোবর মাসে প্রথম সাক্ষাতে এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে অনুরোধ করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এর পরই অত্যন্ত স্বল্প সময়ে ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যারটি উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের মামলার রায় বাংলায় দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা বিভিন্ন আইনি পরিভাষা। এসব পরিভাষার যথাযথ প্রতিশব্দ বাংলায় তৈরি হয়নি। ফলে কোনো রায় ইংরেজি ভাষায় ঘোষিত হলে তা অধিকাংশ বিচারপ্রার্থী জনগণের কাছে বোধগম্য হয় না। ‘জুয়েল সিকদার বনাম রাষ্ট্র মামলায়’ হাইকোর্ট বিচারপ্রার্থীর বোধগম্য ভাষায় রায় প্রকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। ঐ রায়ে বলা হয়েছে, আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি প্রবচন আছে ‘বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখানো’। সময় পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখানোর প্রবণতা এখনো পরিবর্তন হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখের ও বেদনার। বিচারপ্রার্থীর বোধগম্য ভাষায় বিচারকাজ পরিচালনা না হওয়ায় এখনো বোধগম্যতার অভাবে বাঙালি স্বাধীনতার এত বছর পরও হাইকোর্ট দেখার করুণ অভিজ্ঞতার নাগপাশ হতে বাহির হতে পারেন নাই। বিচারপ্রার্থী তার নিজের বোধগম্য ভাষায় বিচার না পাওয়ার বোধগম্যতার অভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বিভ্রান্ত হওয়ায় আদালতগুলোতে এত মামলা মোকদ্দমার জট। এই জট খুলতে পারে শুধু বিচারপ্রার্থীর বোধগম্য ভাষায় তাদের বিচারের বাণী প্রকাশ ও প্রচার। এটা না হলে সেই চির পরিচিত মর্মবেদনার বাণী বারবারই প্রতিধ্বনিত হবে—‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।’

গত ৪ নভেম্বর ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টের রায় বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, বাংলায় অনূদিত রায়গুলো যেন অনলাইনে প্রচার হয়, যাতে সাধারণ মানুষ কি রায় পেল সেটা সে নিজে দেখতে, বুঝতে ও জানতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর অবিরাম প্রচেষ্টা ও পররাষ্ট্রনীতির কারণে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারত থেকে এই সফটওয়্যারটি বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়েছে বলে জানান প্রধান বিচারপতি।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। প্রথম পর্যায়ে কেবল উচ্চআদালতের রায়সমূহ বাংলায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সফটওয়্যার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও পর্যায়ক্রমে নিম্ন আদালতের রায়ও বাংলায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে এই সফটওয়্যারের ব্যবহার সম্ভব হবে।

যেভাবে কাজ করছে সফটওয়্যারটি

‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যারটিতে ইংরেজি রায়ের অনুলিপি প্রথমে আপলোড করা হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট অপশনে গিয়ে রায় রূপান্তর করা হয়। ২০ পৃষ্ঠার একটি রায় রূপান্তরে সর্বোচ্চ ৪ মিনিট সময় লাগে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের অনুবাদ সেল মূল রায়ের সঙ্গে রূপান্তরের বিষয়টি মিলিয়ে দেখেন। এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, এই সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের বেশ কিছু রায় বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে। আরো রায় রূপান্তরের কাজ চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সফটওয়্যারটি ডেভেলপের কাজ করছি। একটি লিগ্যাল ডিকশনারিও এই সফটওয়্যারে অন্তর্ভুক্তির কাজ চলমান রয়েছে। এগুলো সম্পন্ন হলে সফটওয়্যারটি রায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি