শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজন সম্মিলিত দায়িত্ববোধের

আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২০, ১৫:১১

পরিবেশের সকল উপাদান (জীব-জড়) ঠিকভাবে সহাবস্থানে থাকার মধ্য দিয়ে পরিবেশে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই সকল উপাদানের ভারসাম্যপূর্ণ পারস্পারিক যোগাযোগ জগতের নাম বাস্তুসংস্থান। খোলামেলা কথায়, বাস্তুসংস্থান এমন একটা প্রক্রিয়া যেখানে মানুষ, প্রাণী, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সহ নানান প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি পারস্পারিক ক্রিয়ার মাধ্যমে অবস্থান করে। তবে কখনও কখনও এর দু-একটা পরিবেশিয় উপাদান কম বেশি হয়ে যায়। তখনই বিপত্তি ঘটে, ঘটে বিশৃঙ্খলা। বিশ্ব ব্যবস্থা এখন তেমনি এক বিশৃঙ্খল সময়ের মুখোমুখি। আর এই বিপত্তি কিংবা চ্যালেঞ্জের নাম ‘করোনা ভাইরাস’। যার অফিশিয়াল নাম কভিড-১৯।

প্রাথমিকভাবে জানা যায় চীনের উহান প্রদেশের একটি ল্যাবে পরীক্ষাকালীন এই ভাইরাস লিক হয়েছে। যা এখন বিশ্বব্যাপী প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও জোরপূর্বক আতিথেয়তা গ্রহণ করে চলেছে ! তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হল এরকম একটা মহামারী ভাইরাস কেন ল্যাবে তৈরি হচ্ছিল সে বিষয়টি এখনও বিশ্বব্যাপী জানেন না বা বলা যায় জানতে চাইবার মত সময়ই করে উঠতে পারেনি। যদিও বিষয়টি নিয়ে কিছুটা অগোচর অবস্থানেই আছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ তারা বিশ্বব্যাপী যে কয়েকটি জায়গায় সাহায্য শক্তি হিসেবে গেছে সেখানেই আধুনিক ‘সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুত্ব’ শক্তি কায়েম করেছে। শত্রু শক্তিকে হটানোর নামে পাহারায় বসে নিজেই বনে গেছেন সে দেশগুলোর অঘোষিত মোড়ল।

শোনা যায় যুক্তরাষ্ট্র ঐ রাষ্ট্রসমূহের ঘাঁটিতে দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা চালিয়ে আসছে এই ধরণের জীবাণুর। যা নিয়ে প্রায়শই সরব হতে দেখা গিয়েছিল ভেনিজুয়েলা, কিউবা সহ বেশ কিছু দেশের। তাদের সম্পর্কে আরও বলা হয় দেশের বাইরে ঐ ঘাঁটি সমূহে এইসব পরীক্ষার কারণ গবেষণাকালীন কোন বিপর্যয় ঘটলে তা যেন ঐ অপর দেশে প্রতিষ্ঠিত ল্যাবেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ আমেরিকার স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে !

বর্তমান বিশ্ব বাজারে পরাশক্তিধর দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এখন প্রায় সমকক্ষ। বিশ্লেষকদের মতে সব দিকে কর্তৃত্বের ধারাবাহিক জাল বিস্তারে চীনও এই ধরণের গবেষণায় নেমেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মত অপর রাষ্ট্রে চীনের কোন ঘাঁটি না থাকায় পরীক্ষার সময় নিজ দেশে তা ছড়িয়ে পরেছে। যদিও বিশ্ব এই ধরণের জীবাণুগুলোকে পূর্বাপরই জীবাণু অস্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। শুধু তাই নয় এই জীবাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা বিবেচনা করে গোটা বিশ্ব ১৯৭২ সালে বায়োলজিক্যাল উয়েপনস কনভেনশন চুক্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। যাতে স্বাক্ষর করেছিল ১০৯টি দেশ। ১৯৭৫ সাল থেকে এই আইনটি কার্যকর হলেও বহু বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে বলা হয় যে তারা এই আইন মানছে না। যার যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয় কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সংকটকালীন ১৯৭৮-৮১ সালে কিউবায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া। কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোই অভিযোগ করেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের বায়োলজিক্যাল অ্যাটাক বা জৈব রাসায়নিক হামলা।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রতি ১০০ বছর পর পর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বদল হয়। সে হিসেবে বিশ্বে পরাশক্তিধর দেশ হবার লড়াইয়ে চীন এখন অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে। তাই সম্প্রতি সর্বপ্রথম আক্রান্ত হওয়া এই করোনা যে তাদের উপর চালানো অন্য কারো জীবাণু অস্ত্রের প্রয়োগ নয় সে ধারণাও ত্যাগ করা যায় না। শুরুর দিকে কিছু গণমাধ্যম এবং প্রাবন্ধিকও সেই ইঙ্গিত করেছিলেন। তবে যদি এ ধরণের কিছু হয়েও থাকে ধারণা করা যায় চীন কখনই তা স্বীকার করবে না। কারণ তাতে পৃথিবী জানবে বিশ্ব পরাশক্তিধর হবার লড়াইয়ে নামা চীন এখনও নিজেকেই রক্ষা করতে সমর্থ নয়। আর তাতে হারাতে হতে পারে বৈশ্বিক মার্কেট, বন্ধুরাষ্ট্র এবং তিলে তিলে জমা আত্মবিশ্বাস। যদিও এই ধরণের বিশ্লেষণ, ভাবনা এবং শঙ্কাকে হটিয়ে চীন আবারও শক্তির ময়দানে ফিরে এসেছে। ভিন্নভাবে বললে, শুধু ফিরে নয় করোনা সংকটকে এমন মোকাবেলা করেছে যে গোটা বিশ্ব এখন তার দিকে তাকিয়ে। কাজেই এই করোনা সংকট মোকাবেলা পরবর্তী বিশ্ব যে চীনমুখী হবে সেটা বেশ স্পষ্ট।

সেরকমই আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন পথে বাংলাদেশ। যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র বন্ধ ঘোষণা, বিশেষ পরিস্থিতিকালীন ধর্মীয় জমায়েত স্থলগুলো সমাগম না রাখার আহবান এবং দেশের জনগণ ঘরে থাকাকালীন যেন খাদ্য সংকট না হয় সেজন্য আঞ্চলিক প্রশাসন কেন্দ্রগুলোকেও তৎপর রাখা হয়েছে। পাশাপাশি নিরানন্ন এবং ছিন্নমূল মানুষের পাশে বিত্তবানদের এগিয়ে আসবার আহবানের সাথে সাথে তাদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য একেবারে সহনশীল রাখবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে যে বিষয়টি সচেতন নাগরিকগণকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করেছে তা হল রাষ্ট্র কর্তৃক এই ঘরে থাকার উপলক্ষ (ছুটি) বা আহবানে একটা অংশের উদযাপনের ঢং এবং ক্রিয়াশীল আচরণ।

কারণ রাষ্ট্র এই সময়টায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ ঘোষণা করেছে যেন নাগরিকগণ নিজ নিজ ঘরে থেকে একে অন্যকে করোনা আক্রমণ এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেন। কখনই বাস-ট্র্যাক, লঞ্চ কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের পিকআপ ভ্যানে চড়ে গ্রামের পথে রওনা হবার জন্য নয়। যদিও শেষ মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর তৎপরতায় এই স্থানান্তরিত হতে চাওয়া উৎসুক জনপদ থেমেছে। কিন্তু তবুও শহর থেকে অনেকেই গ্রামে ঢুকে পরেছেন। তাই শুধু আঞ্চলিক প্রশাসন নয় বরং প্রতিবেশীদেরও দূরবর্তী অবস্থান থেকে নজরদারি জরুরি।

পাশাপাশি দেশের এই মুহূর্তকালীন সংকটে কোন ধরণের গুজব বা উড়ো কথা যেন নিজেদের মাঝে আত্মকলহ এবং প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের জন্ম দিতে না পারে নাগরিক হিসেবে সেই দায়িত্বও প্রত্যেকের। কারণ ক্ষণিকের এই সংকট কেটে যাবে কিন্তু আচরণ রয়ে যাবে। আর রাষ্ট্রের চিকিৎসকগণ যে মহানুভবতা এবং সাহসিকতা প্রদর্শন করে চলেছেন তাতে তাদের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রয়োজন।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ

ইত্তেফাক/এআর