বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সঞ্চয় শেষ, কাজও নেই, ত্রাণের আশায় দরিদ্ররা

আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২০, ০২:১৭

খাদ্যের আশায় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশ জুড়ে লকডাউনের কারণে ঘরবন্দি মানুষ খাদ্যের আশায় বেরিয়ে আসছে পথে। সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থাপনা সারাদেশে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করলেও দেশের ৬ কোটি দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানো খুব কঠিন হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি উদ্যোগেও বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বিশাল চাহিদার কাছে তা মরুভূমির বুকে এক ফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতোই মিলিয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ত্রাণের আশায় দল বেঁধে নারী-শিশু-বৃদ্ধদের প্রতীক্ষা রাজধানীর জনশূন্য পথে মানুষের হাহাকারকে আরো প্রলম্বিত করে তুলছে।

ঢাকার বস্তিবাসীরা ত্রাণের আশায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার সময় যেটুকু সঞ্চয় ছিল তা খরচ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে তারা বাইরে বের হয়ে এসেছে। কিন্তু অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে জমার টাকাও উঠছে না। এই মানুষগুলো খাদ্যসহায়তা পাওয়ার জন্য উত্সুক দৃষ্টি মেলে বসে আছে পথে।

পান্থপথ সিগন্যাল, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ব্রিজ, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, সোবহানবাগ মোড়, শান্তিনগর মোড়, জিগাতলা মোড়, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁওসহ রাজধানীর মোড়ে মোড়ে দরিদ্র মানুষের জটলা। কেউ খাবার নিয়ে এলেই শত শত মানুষ ঘিরে ধরছে তাদের। এসব অভাবী মানুষ বলছেন, ‘কাজ নাই। ইনকাম নাই। খাওন নাই। এই সময় সরকার সাহায্য না দিলে দিব কেডা?’ প্রশ্ন তাদের।

জাফরাবাদে কয়েকটি বাসায় কাজ করতেন রাফিজা বেগম। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে বাসার কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই বলেছে, পরে আবার কাজে নেবে। জমানো যেটুকু টাকা ছিল, তা দিয়ে দিন চললেও এখন আর হাতে কোনো টাকা নেই। গত ৮-১০ দিন ধরে কাজ নাই তার। স্বামী যে হোটেলে কাজ করেন, সেটাও বন্ধ। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে এদের পথে বসার অবস্থা।

আরও পড়ুন: করোনার উপসর্গ নিয়ে আরো ৯ জনের মৃত্যু

শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, দেশ জুড়েই কর্মহীন মানুষের মধ্যে খাদ্যের জন্য হাহাকার বাড়ছে। করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের চাইতে এই হাহাকার মানুষকে দিশেহারা করে তুলছে। এদিকে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সরকারি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এখনো অনেকেই জমানো টাকায় ভরণপোষণ করছেন। তবে এক সপ্তাহ পরে মানুষের মধ্যে ত্রাণের চাহিদা কয়েক গুণ তীব্র হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (ত্রাণ) মো. ইফতেখারুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘গত ৩০ মার্চ সরকার সারাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য ৮ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল আর ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করে।’ ৬ কোটি দরিদ্র মানুষের বিপরীতে এ বরাদ্দ যে অত্যন্ত নগণ্য, তা বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না।

মো. ইফতেখারুল ইসলাম জানালেন, এই অর্থ ও চাল জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকেরা ইউএনওদের মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় বণ্টন করবেন। আর সিটি করপোরেশন এলাকায় মেয়ররা কাউন্সিলরদের মাধ্যমে এই ত্রাণ বিতরণ করছেন।

এ প্রসঙ্গে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস ইত্তেফাককে বলেন, এই জেলায় সরকারি বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৫৪৭ মেট্রিক টন চাল ও ১৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। সরকারি বরাদ্দ থেকে এ পর্যন্ত ৪০ হাজার পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে এসেছেন। তারাও খাদ্য ও অর্থসহায়তা দিচ্ছেন। তিনি জানান, এ বরাদ্দ দিয়ে আগামী পাঁচ-ছয় দিন পরিবারগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে।

জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অনেক পরিবার ঢাকা থেকে এখানে চলে এসেছে। এদের অনেকের কাছেই কিছু জমানো অর্থ রয়েছে, যা দিয়ে তারা এখন নিজেদের ভরণপোষণ করছেন। তবে এক সপ্তাহ পরে খাদ্যের সংকট তীব্র হতে পারে। আমাদের এখন থেকেই সেই চাহিদা মেটানোর প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।

সিটি করপোরেশনে ত্রাণ বিতরণ প্রসঙ্গে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫০০ জন দরিদ্র মানুষের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে এসব দরিদ্র মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তিনি প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

মানুষ মানুষের জন্য
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজধানীতে ‘লকডাউন’ সময়ে অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। তাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণ। সংকটকালে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি নাম না জানা অসংখ্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ এই সংকট উত্তরণে রাখতে পারে বড়ো ভূমিকা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি এই সাধারণ মানুষের খাদ্যসামগ্রীর সহায়তা প্রেরণামন্ত্র হয়ে দেখা দেয়। জনপ্রতিনিধিরাও সরকারি সহযোগিতার বাইরে গিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন।

ঢাকা ১৪ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হক তার এলাকায় দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছানোর কার্যক্রম শুরু করেছেন। এছাড়া যেসব পরিবার খাবার নিতে আসতে লজ্জাবোধ করবে, তাদের জন্য একটি হটলাইনের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। যেখানে ফোন করলে কর্মীরা সেই বাসায় গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে আসবেন। এছাড়া পুলিশও মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে ফুটপাতে খাবার দিতে দেখা গেল পুলিশের একটি গাড়ি থেকে। রায়েরবাজার বধ্যভূমি ‘নামাবাজার’-এ থাকলেও একটি পরিবার খাবার নিতে এসেছে এখানে। দুই মেয়ে নিয়ে আব্বাস সরদার রাপা প্লাজার সিঁড়িতে বসেই খেয়ে নিচ্ছিলেন। জানালেন, রাতে কী খাবেন জানেন না।

ইত্তেফাক/বিএএফ