শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনায় গুজব, গুজবের করোনা

আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১২:৫৭

ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে করোনা সংক্রমণে একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। এর পর পরই নাকি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এসে সেই চিকিৎসকের মৃত দেহটি নিয়ে গেছেন। সম্ভবত মার্চের নয় তারিখের কথা। মাত্র একদিন আগেই দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছেন। মানুষ তখনও ধাক্কাটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

আমি সেদিন রাতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে ছিলাম। অনুষ্ঠানটি যখন অন এয়ার, এমনি সময় একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর টেক্সটে খবরটা পেলাম। উত্তরে টেক্সট পাঠিয়ে জানতে চাইলাম খবরটার উৎস কি? সহকর্মীটি জানালেন ঐ হাসপাতালে কর্মরত এক চিকিৎসকের কাছ থেকেই তিনি এই তথ্যটি জানতে পেরেছেন। গুজব ছড়ানো তার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু অমন অথেনটিক সোর্স থেকে খবরটা পেয়ে তিনি মনে করেছেন বিষয়টি আমার সাথে শেয়ার করা উচিৎ। টকশোটির স্বনামধন্য হোস্ট তার শো চলাকালীন সময়ে আমার টেক্সট চালাচালি যে খুব ভালো ভাবে নিচ্ছেন না তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। বিজ্ঞাপন বিরতিতে তাকে বিষয়টা জানালাম। অনুষ্ঠান শেষ হতেই দু-চার জায়গায় টেলিফোন ঘুড়িয়ে আমরা আশ্বস্ত হলাম যে বিষয়টি বানোয়াট। বুঝলাম সংকট শুরু হতে দেরি হয়, কিন্তু ‘ওদের’ দেরি হয় না মোটেও। একদল লোক বসেই থাকেন ঝোপটা বুঝে কোপটা মারার অপেক্ষায়।

এইতো দু’দিন আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে যে ভিডিও কনফারেন্সটি করেছেন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের কল্যাণে আমরা দেখেছি সেখানেও এই বিষয়টি উঠে এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরাসরিই বলেছেন, এসবের তিনি থোরাই পরোয়া করেন। তিনি কাজে বিশ্বাসী এবং সবাইকে তিনি এসব গুজবে কান না দিয়ে যার যার কাজ করে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। যে কোন যুক্তিবাদী মানুষই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই পর্যবেক্ষণের সাথে একমত হবেন এক কথায়। কিন্তু খুব ভালো করে জানি তারপরও এরা হাল ছাড়বে না। হাল এরা ছাড়েনি অতীতেও। কাজেই ভবিষ্যতেও এদের কাছ থেকে কোন ধরনের শুদ্ধ আচরণ অন্তত আমার কাছে প্রত্যাশিত নয়।

এই এক করোনাকে নিয়ে কত ভাবেই না বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, হচ্ছে। থানকুনি পাতা থেকে শুরু করে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ - বাদ যায়নি কোন কিছুই। ফেসবুকেই দেখেছি এদেশ থেকে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ নাকি রফতানি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে! আমার নিজের চেম্বার এসিস্টেন্ট এর কাছে শুনেছি তার বাসার আশেপাশে রাতের বেলা লোকজন টর্চ লাইট জালিয়ে থানকুনি পাতার খোজ করছে। তারপরও কেন যেন এবার এই সব গুজব হালে খুব একটা পানি পাচ্ছে কম। মানুষ তাদের কথায় একেবারে যে বিভ্রান্ত হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু এ ধরনের মানুষের সংখ্যা এবারে কম। আর পাশাপাশি বিশেষ কোন একটা গুজব খুব বেশি দিন স্থায়িত্বও পাচ্ছে না। কেন যেন মানুষ এবারে অন্যান্য বারের চেয়ে একটু বেশি সচেতন। আমরাইতো চাঁদে সাইদীকে দেখার গুজব শুনে মানুষকে রাস্তায় নেমে মরতে দেখেছি। বোরহানউদ্দীনে আর তারও আগে নাসিরনগরে দেখেছি গুজবে অন্ধ মানুষের উন্মোক্ত আচরণ। সে তুলনায় এবারের পরিস্থিতি তো ঢের ভালো। এজন্য মূল ধারার মিডিয়া কর্মীরা অবশ্যই সাধুবাদের দাবিদার।

কদিন আগেই দেখলাম অস্ট্রেলিয়ার সরকার একটা নতুন অ্যাপস তৈরি করেছেন যাতে সে দেশের মানুষ গুজবে বিশ্বাস না করেন। আর ব্রিটিশ সরকার ফেসবুকে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে যে কদিন আগে থেকে মাঠে নেমেছেন সে কথাও আমাদের জানা। মাঠে নেমেছেন আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীও। এ নিয়েও অবশ্য গুজব ছড়ানো হয়েছিল। অন্তত দু’দিনের জন্য কেউ কেউ বিশ্বাস করছিলেন যে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদি সকল ধরনের সামাজিক যোগাযোগের জায়গাগুলো সরকার নজরদারীতে নিয়ে আসতে যাচ্ছেন। অবশ্য এবারের করোনা কেন্দ্রিক গুজবের যে ট্রেন্ডটি আমরা দেখছি, সেই ট্রেন্ড মতোই এই গুজবটিও খুব একটা ভাত পায়নি। মূল ধারার মিডিয়ার তৎপরতায় দ্রুতই মাঠে মারা গেছে।

তবে এটা শিকার করতে হবে যে একটা গুজব এখনও মানুষের মনে ইতি-উতি উকি দিচ্ছে। অনেকেরই ধারনা করোনায় এদেশে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। রোগীও আছে অনেক বেশি। সরকার ইচ্ছে করে তা চেপে রাখছেন। এমন কি এও শুনেছি সরকার নাকি মুজিব বর্ষের উদযাপন নির্বিঘ্ন করতে এমনটি করছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী সনাক্ত হওয়ার সাথে সাথেই জাতির পিতার দুই কন্যা তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে এই উদযাপনকে ন্যুনতমে নামিয়ে এনেছেন। এটা আসলে মানুষের একটা অদ্ভুত প্রবৃত্তি। এই যে এতো উন্নত জাপান, এমনকি সেখানে রটানো হচ্ছিলো যে সেদেশের সরকার নাকি অলিম্পিক আয়োজনের ধান্দায় দেশকে লকডাউনে নিচ্ছেন না। তবে এদেশে করোনায় মৃত্যু নিয়ে গুজবটা যেহেতু কিছুটা হলেও ভাত পাচ্ছে, এই বিষয়টা আমাদের আলোচনায়-প্রচারণায় আরো বেশি করে নিয়ে আসা উচিৎ।

যারা বলতে চায় যে করোনায় মৃতের সংখ্যাটা অনেক বেশি, তাদের জন্য একটা সহজ পাটিগণিত। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের একদল গবেষক সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ  বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এ পরপর দুটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। সেই প্রকাশনাগুলো থেকে আমরা জানতে পারছি যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত যেসব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আইসিইউ সার্পোট নিতে হয় তাদের গড়ে দশ দিনের মত হাসপাতালে থাকতে হয়। অর্থাৎ দশ দিনে তারা হয় ভালো হয়ে বাসায় ফিরে যাবেন, অথবা তাদের মধ্যে কেউ কেউ আর ফিরবেন না। সেই হিসেবে কোন দেশে করোনা আক্রান্ত প্রথম যে রোগীটি মৃত্যুবরণ করবেন, গড়ে তার দিন দশেক আগে সেদেশে প্রথম সিম্পটোমেটিক কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত হওয়ার কথা। বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছিল ১৮ মার্চ। আর প্রথম সিম্পটোমেটিক কোভিড-১৯ রোগীরা সনাক্ত হয়েছিলেন ৮ মার্চ। হিসেবটা মিলছে কি?

করোনার কারণে আমরা ইদানীং অনেক নতুন নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হচ্ছি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এপিসেন্টার। শব্দটি আসলে ব্যবহার করা হতো আণবিক বোমা যেখানে বিস্ফোরিত হয় সেই জায়গাটাকে বোঝানোর জন্য। আণবিক বোমা বিস্ফোরণে ক্ষতির মাত্রাটা সবচেয়ে বেশি হয় ঐ জায়গাটিতেই। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মানবজাতি তেমনটিই দেখেছে। লক্ষ্য করুন এবারের এই করোনা দুর্যোগের প্রথম এপিসেন্টারটি ছিল চীনে আর এখন তা ইউরোপে। আশংকা করা হচ্ছে করোনার পরের এপিসেন্টারটা হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত উষ্ণ প্রধান কোন অঞ্চলে করোনার এপিসেন্টার দেখা যায়নি। পাশাপাশি করোনায় বিশ্বব্যাপী যে মৃত্যুর মিছিল, তাতে শতকরা ৯৫ জনই মারা গেছেন শীত প্রধান অঞ্চলে। বাংলাদেশ তো পৃথিবীতে কোন বিচ্ছিন্ন দীপ নয় যে কোন কথা নেই, বার্তা নেই এখানে সহসা শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ মৃত্যু বরন করবেন। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারত কিংবা এমনকি পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে দেখুন না কেন? এখন পর্যন্ত এসব কোন দেশেইতো আমরা শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষকে মৃত্যু বরন করতে দেখিনি। এমন কি শীত প্রধান প্রতিবেশী নেপালেওতো করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ মৃত্যু বরন করেননি, আর ভুটানে রোগী পাওয়া গেছে সাকুল্যে একজন।

আজকের এই অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে শয়ে-শয়ে কেন, একটি-দুটিই অস্বাভাবিক মৃত্যুইতো লুকিয়ে রাখা দুষ্কর। আর সেই দেশেতো তা একেবারেই অসম্ভব যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি আর সাথে আছে পঁচিশটিরও বেশি ইলেকট্রনিক ও কয়েকশ প্রিন্ট মিডিয়া। আর সব চেয়ে বড় কথা আছে আরো পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী।

যে জিনিষটা অবশ্য এখনও আমার মাথায় ঢোকেনা তা হলো কেউ যদি যদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে যে এ দেশে শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ করোনায় মৃত্যুবরণ করছেন, তাহলে তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পরবে যে তাদের নিজেদের আচরণে এর কোন ধরনের প্রতিফলন আছে? আমি তো সেরকমটা দেখি না। তারা কি ঐ লাখো মানুষের ভিড়ে সামিল ছিলো না যারা করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত ছুটিকে ঈদের ছুটি বানিয়ে ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিল। একজন মানবিক প্রধানমন্ত্রীর মানবিক উদারতাটাকে তামাশায় পরিণত করায় মিছিলে যোগ দিতে তারা কি সেদিন শাহবাগে যায়নি? তাদের কেউই কি বাজারের বা মোড়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ফাকে-ফাকে এই লেখাটা পড়ে আমাকে শাপ-শাপান্ত করছেন না?

যারা এখনও গুজব ছড়াচ্ছে বলবো, ফেসবুকের ওয়ালে বা পেজে পরের গুজবটা টাইপ করার আগে তাদের একটু ভাবতে বলবো যে এটি সরকারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টার সময় নয়। এখানে সরকার পতনেরও কোন সুযোগ নেই। কিন্তু কারো সামান্য দায়িত্ব জ্ঞানহীনতায় পরিস্থিতির যদি একটি বারের জন্যও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, এর ধাক্কাটা সবার আগে এসে পড়বে আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর উপরই। কারণ করোনা ভাইরাস কোন দল চেনে না আর এদেশের কিছু বাংলাস্তানীদের মত এর কোন পাকিস্তান প্রীতিও নেই!

লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

ইত্তেফাক/আরএ