শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জাতিসংঘে শেখ সাদির কবিতা

আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২০, ০১:৫৬

প্রায় আটশো বছর আগে পারস্যের অমর কবি শেখ সাদি ‘বনি আদম’ কবিতাটি রচনা করেন। একটি গালিচায় লিপিবদ্ধ হয়ে কবিতাটি আদর্শবাণী হিসেবে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরের সভাকক্ষে শোভিত হয়েছে।

শেখ সাদি ফার্সি ভাষায় সুন্দর বাচনভঙ্গিতে বনি আদম কবিতাটি রচনা করেছিলেন :

বনি আদম

‘বনি আদম আযায়ে ইয়েক দিগারান্দ

কে দার আফারিনেশ জে ইয়েক গওহারান্দ

ছো ওজভি বে দর্দ আভারাদ রুজেগার

দেগার ওজভা রা না মানাদ ঘারার

তু কাজ মেহনত-এ দিগারান বিঘাম-ই

না-শায়েদ কে নামাত নাহান্দ আদমি’

কবিতাটির ফার্সি থেকে ইংরেজি আক্ষরিক অনুবাদ করেন অ্যাডওয়ার্ড ইস্টউইক, যার বাংলায় অনুবাদ দাঁড়ায়—

‘আদম সন্তানরা একে অন্যের অংশ

তাদেরকে একই উত্স থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে

যদি কখনো একটি অঙ্গে আঘাত লাগে

(তখন) অন্যান্য অঙ্গ শান্ত থাকতে পারে না।

আপনি যদি অপরের দুঃখে সাড়া না দেন

তাহলে আপনি মানুষ নামের যোগ্য নন।’

অনেকে মনে করেন, এই কবিতাটি মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর একটি হাদিস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা :

‘মাতালুল-মুমিনিনা ফি তাউদ্দিহিম ওয়া তারাহুমিহিম ওয়া আতুফিহিম মাতালু ল-জাসাদ: ইদা স্তাকা মিনহু উদউন তাদাইলাহু সাইরুল-জাসাদি বিস-সাহারি ওয়াল-হুম্মা।’

‘বিশ্বাসীদের (মুসলিম) পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ, করুণা এবং সমবেদনার দৃষ্টান্ত হচ্ছে একটি মানবদেহের মতো। যখন দেহের একটি অঙ্গে বেদনা হয়, অবশিষ্ট শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরাক্রান্ত হয়।’ অনেক সময় এই হাদিসটি উদ্ধৃত করার সময় মাতালুল-জাসাদ-এর (‘শরীরের মতো’) জায়গায় মাতালুল-জাসাদিল-ওয়াহিদ (একটি দেহের মতো) বলা হয়।

শেখ সাদির উপরোক্ত কবিতাটি মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ঘোষণার অন্তর্নিহিত অর্থের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ প্যারিসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে উপরোক্ত ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদটি এভাবে লেখা ছিল :

‘সকল মানুষ সমঅধিকার এবং মর্যাদাসহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। সকলেই জন্মসূত্রে বিচারবুদ্ধি এবং বিবেকের অধিকারী হয়। প্রত্যেকেই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিত।’

শেখ সাদির (১২১০-১২৯২) পুরো নাম আবু মোহাম্মদ মুসলিহউদ্দিন আবদাল্লাহ শিরাজি, তিনি শেখ সাদি বা শিরাজের সাদি নামেও পরিচিত। তিনি মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ ফার্সি ভাষার কবিদের অন্যতম। এছাড়া ফার্সিভাষী দেশের বাইরেও তিনি সমাদৃত। তাঁর কবিতার মান এবং সামাজিক ও নৈতিক চিন্তার গভীরতার কারণে ধ্রুপদি সাহিত্যের ক্ষেত্রে শেখ সাদিকে একজন উঁচুমানের কবি ধরা হয়। তিনি পারস্যের পণ্ডিতদের মধ্যে ওস্তাদ বিবেচিত হন। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার মতে, তাঁর রচিত ‘বুস্তান’ গ্রন্থটি সকল যুগের একশ সেরা গ্রন্থের একটি হিসেবে বিবেচিত।

‘বুস্তান’ এবং ‘গুলিস্তাঁ’ ছাড়াও শেখ সাদি চারটি প্রেমের কবিতার বই (গজল) এবং বেশ কয়েকটি কাসিদা রচনা করেছেন। রুমি এবং হাফিজের সঙ্গে তাঁকেও ফার্সি ভাষার অন্যতম প্রধান একজন গজল লেখক মনে করা হয়।

সাদি বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক বিজ্ঞান, আইন, সরকার পরিচালনা, ইতিহাস, ফার্সি সাহিত্য এবং ইসলামিক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। এতে একটি ধারণা পাওয়া যায় যে, এখানে পড়াশোনা করার জন্য তিনি বৃত্তি পেয়েছিলেন। তাঁর রচিত গুলিস্তাঁ মহাকাব্যে তিনি বর্ণনা করেন যে, ইসলামি পণ্ডিত আবুল ফারাজ ইবনে আল জাওজির অধীনে তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। বাগদাদে তিনি যা যা দেখেছিলেন, তার বিশদ বিবরণ তাঁর রচনায় তুলে ধরেন।

বুস্তান ও গুলিস্তাঁ গ্রন্থে সাদি তাঁর সফরের ছোট ছোট বিভিন্ন সত্য ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন। মোঙ্গলরা যখন খাওয়ারেজম এবং ইরানে হামলা করে, তখন যে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার কারণে তিনি পরবর্তী ত্রিশ বছর আনাতোলিয়া, সিরিয়া, মিসর এবং ইরাকের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তাঁর রচনায় তিনি মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজি এবং মুফতি, বিশাল বাজারসহ সংগীত এবং চিত্রকলার কথাও তুলে ধরেন। হালাবে (প্রাচীন আলেপ্পো) তিনি একদল সুফির সঙ্গে যোগ দিয়ে ক্রুসেড যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। অ্যাকরে ক্রুসেডাররা তাঁকে বন্দি করেছিল এবং সেখানে একজন দাস হিসেবে সাত বছর তিনি দুর্গের বাইরে পরিখা খনন করার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মামলুকরা মুক্তিপণ দিয়ে অন্যান্য মুসলিম বন্দির সঙ্গে তাঁকেও ক্রুসেডারদের কাছ থেকে মুক্ত করেছিলেন। এছাড়া তিনি জেরুজালেমও সফর করেছিলেন এবং মক্কা-মদিনায় তীর্থযাত্রা করেছিলেন।

গুলিস্তাঁ গ্রন্থটিতে কবিতা এবং গল্পের সমাহার রয়েছে, যেরকম একটি ফুলবাগানে বিভিন্ন ফুলের সমাহার থাকে। এই বইটি জ্ঞানের একটি উত্স হিসেবে বিবেচিত। বহুল পরিচিত একটি প্রবচন পাশ্চাত্যে বারবার আলোচিত হয়ে থাকে, ‘জুতা না থাকার কারণে কোনো এক লোক একদিন হায় হায় করছিল, তারপর যখন সে আরেক লোকের দেখা পায় যার দু পা নেই, তখন তার প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আমার প্রতি ঈশ্বরের অফুরন্ত দানশীলতার কথা স্মরণ করে আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই।’ এই কথাগুলো গুলিস্তাঁ কাব্যগ্রন্থ থেকেই এসেছে। ফার্সি ভাষায় একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, ‘সাদির প্রতিটি শব্দের বাহাত্তরটি অর্থ আছে। পাঠকের মনোরঞ্জন এবং বাস্তব এবং নৈতিক দিক ছাড়াও, এই গল্পগুলো প্রায়শই দরবেশদের আচরণের ওপর কেন্দ্রীভূত থাকে। এছাড়া এগুলোতে সুফিতত্ত্বের শিক্ষাও রয়েছে। গুলিস্তাঁ কাহিনিগুলো রাজা থেকে শুরু করে একজন চাষার কাছেও অজানা নয়।

বনি আদম কবিতটির ভিন্ন ভাষ্য :পেয়কার

‘ইয়েকদিগার’ অর্থাত্ ‘একে অন্যের’ শব্দটিসহ বনি আদম কবিতার উপরোক্ত ভাষ্যটি প্রথমদিককার সকল পাণ্ডুলিপিতে দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর তারিখ গুলিস্তাঁ কাব্যগ্রন্থটি রচনার ৫০ বছরের মধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। ১৯ শতকের ইরানি কবি হবিব ইয়াঘমাই লিখেছিলেন :“বিশ বছর আগে যখন আমি সাদির কর্মসংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরির কাজে প্রয়াত মোহাম্মদ আলি ফারুকিকে সহায়তা করছিলাম, তখন বেশ কয়েকটি প্রাচীন এবং নির্ভরযোগ্য পাণ্ডুলিপি আমাদের হাতে এসেছিল। এগুলো রচনার তারিখ ছিল ৭১৭ (১৩১৭-৮ খ্রি.) এবং ৭২৪ (১৩২৪ খ্রি.)। এই পাণ্ডুলিপিগুলোতে ‘বনি আদম’ কবিতায় ‘বনি আদম আযায়ে ইয়েকদিগার’ কথাগুলো ছিল।”

উল্লেখ্য, এই ভাষ্যটি সম্পাদনা করেছিলেন প্রখ্যাত লেখক এবং ইরানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলি ফারুকি। পরবর্তীকালে এই কবিতাটিই একটি গালিচায় বুনে ২০০৫ সালে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের দেয়ালে স্থাপন করা হয় এবং ২০১০ সালে ইরানের ১০০,০০০ রিয়ালের নোটের উল্টোপিঠেও ছাপা রয়েছে।

তবে কোনো কোনো পুস্তকে লেখাটি একটু অন্যরকম দেখা যায়, ‘বনি আদম আযায়ে ইয়েক পেকারান্দ’ (অর্থাত্ আদম সন্তানেরা একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ)। তবে ইয়েকদিগার লেখা ভাষ্যটিই উপরোক্ত হাদিসটির বেশ কাছাকাছি বলা যায়। অধিকাংশ ইংরেজি অনুবাদেও এই ভাষ্যটি অনুসরণ করা হয়।

একটি ভাষ্য করেছেন অধ্যাপক হোসেইন ওয়াহিদ দস্তরজি :

আদম সন্তানেরা একই দেহের অঙ্গ, বলা যায়;

কেননা ওরা একই মাটি থেকে সৃষ্ট।

একটি অঙ্গে যদি আঘাতে যন্ত্রণা হয়,

তখন অন্যান্য অঙ্গেও তীব্র যন্ত্রণা হয়।

তুমি যদি মানুষের কষ্টে সাড়া না দাও,

তবে তুমি ‘মানুষ’ নামের যোগ্য নও।

আরেকটি ভাষ্য আলি সালামির কাছ থেকে এসেছে :

মানুষ আসলে একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ;

কেননা, মানুষকে একই আত্মা আর বীজ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

যখনই একটি অঙ্গ যন্ত্রণায় কাতর হয়,

তখন অন্যান্য অঙ্গও যন্ত্রণা অনুভব করে।

মানুষের দুঃখ-বেদনার প্রতি যে সমব্যথী নয়,

তাকে আর মানুষ বলা যায় না।

অন্য দিকে রিচার্ড জেফরি নিউম্যানের ভাষ্যে :

সকল নারী ও পুরুষ একে অপরের

একটি মাত্র দেহের অঙ্গ; সকলকেই নেওয়া হয়েছে

প্রাণের ঝিকমিক করা নির্যাস, ঈশ্বরের নিখুঁত মুক্তা থেকে;

এবং কারো প্রাণে যখন আঘাত লাগে, যার অংশীদার আমরা সবাই,

তখন সবাই সেই আঘাতের অংশীদার হয়, যেন এটা সবারই নিজস্ব বেদনা।

তুমি যদি অপরের যন্ত্রণা অনুভব না কর,

তবে তুমি মানুষ নামের অধিকার থেকে বঞ্চিত হও।

জাতিসংঘের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন একবার তেহরানে বলেছিলেন :‘জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ঢোকার মুখের দেয়ালে একটি জমকালো গালিচা রয়েছে—আমার মনে হয় ইরানের জনগণের কাছ থেকে উপহার পাওয়া এই গালিচাটি এ যাবত্ জাতিসংঘের সংগ্রহে সবচেয়ে বড়ো গালিচা। এর ওপর পারস্যের মহান কবি শেখ সাদির একটি কবিতার চমত্কার কতগুলো শব্দ বোনা রয়েছে :

‘সকল মানব একই কাঠামোর অঙ্গ,

যেহেতু এগুলো সর্বপ্রথম একই নির্যাস থেকে উদ্ভূত।

(তাই) কখনও একটি অঙ্গ ব্যথায় কাতর হলে

অন্য অঙ্গগুলো শান্ত থাকতে পারে না।

তুমি যদি অপরের দুঃখ অনুভব না কর

তাহলে তোমার নাম মানুষ নয়।’’

বনি আদম কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট

শেখ সাদি প্রবচন বা সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভ বাণী রচনার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে গুলিস্তাঁ কাব্যগ্রন্থের বনি আদম কবিতাটি। এই কবিতায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে মানুষের মধ্যেকার সকল বাধা ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

কবিতাটি শেখ সাদির গুলিস্তাঁ কাব্যগ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের দশম কাহিনির একটি অংশ। কাব্যগ্রন্থটি ১২৫৮ সালে সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই পর্বের শিরোনাম ছিল ‘রাজার আচরণের বিষয়।’ এর কাহিনিতে দেখা যায় শেখ সাদি দামেস্কের বিশাল মসজিদে জন দ্য ব্যাপটিস্টের কবরে প্রার্থনা করছেন।

তিনি তখন সেখানে অনুরুদ্ধ হয়ে একজন অজানা আরব রাজাকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। ঐ রাজা সাদিকে অনুরোধ করছিলেন, তিনি যেন তার জন্য প্রার্থনা করেন, কেননা একজন শক্তিশালী শত্রুর হুমকিতে রাজা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। শেখ সাদি সেই রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, তিনি যদি উচিত শাস্তির শঙ্কামুক্ত জীবনযাপন করতে চান, তবে তাকে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে রাজ্য শাসন করতে হবে। দুটি সংক্ষিপ্ত কবিতার মাধ্যমে তিনি উপদেশগুলো দিয়েছিলেন, যার দ্বিতীয়টি ছিল বনি আদম কবিতা।

রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন অনূদিত ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থে উপরোক্ত কবিতাটি রচনার প্রেক্ষাপট এভাবে শেখ সাদির ভাষায় উদ্ধৃত করা হয়েছে :‘দামেস্কের ক্যাথেড্রাল মসজিদে আমি নবী ইয়াহিয়ার কবরের মাথার দিকে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করছিলাম, এমন সময় একজন কুখ্যাত আরব রাজা সেখানে হাজির হলেন। এই রাজা তীর্থযাত্রা করতে এসেছিলেন। কাকুতিমিনতির সাথে তিনি তার মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য আরজ করলেন—

‘দরবেশ এবং ধনবান, ধনী ও গরিব নির্বিশেষে সকলেই এই দ্বারপ্রান্তের মেঝেতে দাস আর যারা সবচেয়ে ধনবান, তারাই সবচেয়ে দীনদরিদ্র বা কাঙাল।’

তারপর তিনি আমাকে বললেন :‘দরবেশরা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, গভীর অনুভূতিপ্রবণ এবং তাঁদের কাজে অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ হন। আপনার হূদয়ের সাথে আমার হূদয়কে একীভূত করুন, কেননা আমি একজন শক্তিশালী শত্রুর কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছি।’ আমি উত্তর দিলাম :‘আপনার দুর্বল প্রজাদের প্রতি দয়া দেখান, তাহলে কোনো শক্তিশালী শত্রু আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’

‘শক্তিশালী বাহু এবং কব্জির জোর দিয়ে

একজন গরীব মানুষের পাঁচ আঙ্গুল ভেঙ্গে দেওয়াটা পাপ।

তাকে ভীত হতে দিন, যে পতিতকে করুণা করে না

কেননা সে যদি পড়ে যায়, তাহলে কেউ তার হাত ধরবে না।

যে মন্দ বীজ বপন করে ভালো ফল আশা করে

সে ব্যর্থ হওয়ার জন্যই এবং বিনা কারণে মাথা ঘামায়।

কান থেকে তুলো বের করে মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করুন

আর যদি তা করতে ব্যর্থ হন, তবে একদিন ঠিকই শাস্তি পাবেন।’

ধারণা করা হয় যে, গুলিস্তাঁ কাব্যগ্রন্থটিতে সরাসরি কুরআন বা হাদিস থেকে চল্লিশটি পঙিক্ত উদ্ধৃত করা হয়েছে।

জাতিসংঘ প্রসঙ্গ

১৯২৮ থেকে ১৯৩০ সময়টিতে জাতিসংঘের পূর্বসূরি লিগ অব নেশনে ইরানের প্রথম প্রতিনিধি ছিলেন মোহাম্মদ আলি ফারুকি।

১৯২৯ সালে প্যারিসে একটি বক্তৃতায় ফারুকি বর্ণনা করেন যে, সেপ্টেম্বর ১৯২৮, জেনেভায় লিগ অব নেশনের একটি ভোজসভায় আলবেনিয়ার প্রতিনিধি প্রস্তাব করেন যে, শেখ সাদির কবিতাটি এই সংগঠনের একটি চমত্কার আদর্শবাণী হতে পারে। আলবেনিয়া তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

সম্ভবত তাঁর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি, তবে অনেক বছর যাবত্ ইরানে একটা জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল যে, সাদির কবিতাটি জাতিসংঘের সদরদপ্তরের প্রধান ফটকে খোদাই করা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ জাভেদ জরিফ জেনেভা এবং নিউ ইয়র্ক—এই দুই জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এ ধরনের খোদাই করা কোনো লিপিফলক দেখতে পাননি।

যা-ই হোক এই জরিফের সময়েই ইসফাহানের একটি বিখ্যাত গালিচা তৈরির কারখানার মালিক মোহাম্মদ সেইরাফিয়ান জানালেন যে, তাঁর কাছে পাঁচ মিটার লম্বা এবং পাঁচ মিটার প্রস্থের একটি গালিচা রয়েছে, যার ওপর সোনার হরফে সাদির ঐ কবিতাটি বোনা হয়েছিল এবং তিনি এই গালিচাটি জাতিসংঘকে উপহার দিতে চান। ইরানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত, মোহাম্মদ আলি জরিফের মতে, এই গালিচাটিই ২০০৫ সালে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সভাকক্ষের প্রবেশদ্বারে টাঙানো হয়েছে।

২০০৯ সালের ২০ মার্চ পারসিক নববর্ষ—নওরোজের দিন ইরানিদের উদ্দেশে একটি শুভেচ্ছাবার্তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বনি আদম কবিতাটির প্রথম লাইনটির তরজমা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন :‘অনেকেই জোর দিয়ে বলেন যে আমাদের মধ্যেকার বিভেদ দিয়েই আমাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করা উচিত। তবে বহু বছর আগে কবি শেখ সাদির বলা কথাগুলো আমাদের স্মরণ করতে হবে : ‘একই উত্স থেকে সৃষ্ট আদম সন্তানেরা একে অন্যের অঙ্গ।’

তথ্যসূত্র :ইন্টারনেট

ইত্তেফাক/জেডএইচ