হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ! [বৈশাখ/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
প্রায় প্রতিটি বৈশাখই রুদ্র রূপ নিয়ে আসে আমাদের মাঝে। এই রুদ্র রূপের প্রকাশ কখনো প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্য দিয়ে, আবার কখনো কালবৈশাখীর থাবায়। প্রায় প্রতিটি বৈশাখেই কালো মেঘের ঘনঘটায় ধুলায় ধূসরিত হয় আমাদের কাছের পৃথিবী। আবার প্রচণ্ড দাবদাহে নিমিষেই বৃষ্টি ঝরিয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় প্রকৃতির বুকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমানে বৈশাখ মানেই আনন্দে উদ্বেলিত বাঙালি। বাংলা নববর্ষের এই বর্ণিল আয়োজন বাঙালির প্রাণে অনাবিল আনন্দ, উৎসাহ-উদ্দীপনা আর সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আসে। বৈশাখ মানেই বাংলার লোকজ-সংস্কৃতির মূল্যবান অনুষঙ্গ- গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, আদিবাসী পল্লীতে বৈসাবি উৎসব, যাত্রাগান, পালাগান, পুতুলনাচ, অঞ্চলভিত্তিক লোকসংগীত, ঘোড়দৌড় প্রভৃতি। এর পাশাপাশি রয়েছে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব। এছাড়া রাজধানীসহ সারা বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরেও মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৈশাখকে বরণ করে নেওয়ার সংস্কৃতিও চালু হয়েছে।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির আবহমানকালের সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক উৎসব। এই উৎসবের মধ্যেই রয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়, জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির বিকাশ। এর মধ্যদিয়েই বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা বছরের পর বছর ঋদ্ধ হচ্ছে। তাই পহেলা বৈশাখ উদযাপন বা বাংলা বর্ষবরণ কেবল আনুষ্ঠানিকতানির্ভর কোনো উৎসব নয়। এই দিনটি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও শেকড় সন্ধানের পরিচয়ও বহন করে।
কথায় আছে, বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। হিন্দু সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বাংলা ১২ মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। ওই সৌরপঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে। এ সময় পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। আর এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। মুঘল স¤্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফসলের সঙ্গে মিলত না। এ কারণে কৃষককে অসময়ে খাজনা প্রদান করতে হতো। এ সমস্যা সমাধানের জন্যই সম্রাট আকবর বর্ষপঞ্জি সংস্কারের আদেশ দেন। তিনি এই কাজের দায়িত্ব প্রদান করেন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহ-উল্লাহ সিরাজীকে। তিনি সৌর সন ও হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম প্রবর্তন করেন। একে বলা হতো ‘সন-ই-ইলাহি’। কালের পরিক্রমায় এটি বাংলা সন বা ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই সন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় ১৫৫৬ সালে আকবরের সিংহাসনের সময় থেকে। তবে বাংলাদেশে খ্রিষ্টীয় বছরের ১৪ এপ্রিল বাংলা সনের প্রথম দিন হিসেবে পালন করা হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতে ওই দিনটি পালিত হয়ে আসছে ১৫ এপ্রিল।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই জাতি বারবার বিদেশি শক্তির দ্বারা শাসনের নামে শোষিত ও নিঃগৃহীত হয়েছে। রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং উৎসব পালনেও নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে এই জাতিকে। বিভিন্ন সময়ে বাঙালির সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আঘাত করা হয়েছে। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিনদেশি সংস্কৃতি। কিন্তু বাঙালি তা কখনো মেনে নেয়নি। বাঙালি তার আপন সত্তায় বলীয়ান হয়ে ঐতিহ্য ও আদর্শ ধরে রেখেছে।
ভারতবর্ষে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। ওই সময় সবাইকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমিমালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি মুখ করিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে নানা উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসব কালক্রমে সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। সম্রাট আকবরের আমল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হলেও এ অঞ্চলে দিনটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে ভারতবর্ষ ভাগের পর থেকে। অসঙ্গত রাজনৈতিক মীমাংসার ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতে যুক্ত হলে পূর্ববাংলার বাঙালিদের সংস্কৃতি পড়ে হুমকির মুখে। দেশভাগের পর প্রথমেই বাধা আসে রাষ্ট্রভাষা বা মাতৃভাষার প্রশ্নে। বাঙালি তাদের ভাষার অধিকারের জন্য প্রাণ দেয়। ভাষার প্রশ্নে শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালির এ আন্দোলন জাতির মধ্যে এক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। আর ওই চেতনাই হলো বাঙালির জাতীয়তাবাদ।
আরো পড়ুন: ভালো চিকিৎসক হতে হলে প্রথমে ভালো মানুষ হতে হবে: ভুটানের প্রধানমন্ত্রী
দেশ বিভাগের পর ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের অসাড়তা প্রমাণিত হওয়ায় প্রগতিশীল ছাত্র-বুদ্ধিজীবীর চেতনায় পহেলা বৈশাখ নতুন রাজনৈতিক মাত্রায় বিকশিত হয়। বাংলা নববর্ষের এ দিনটি বাঙালির জাতীয়তাবাদ চেতনাকে শাণিত করতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির নববর্ষ পায় ভিন্ন মাত্রা। ওই সময়কার অনুষ্ঠানাদি ছিল মূলত বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা পাকিস্তানি শাসকের প্রতি পূর্ববাংলার মানুষের প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ। এসবের মধ্যদিয়ে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব হয়ে উঠেছিল বাঙালি চেতনার ধারক ও বাহক। এই উৎসব জাতীয়তাবাদ চেতনায় বিস্তার লাভ করে এ অঞ্চলের মানুষের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে প্রেরণা জোগাতে থাকে।
এদিকে ষাটের দশকে পশ্চিম পাকিস্তান গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সাহিত্য ও সংগীতচর্চা বন্ধের চক্রান্ত করে। পশ্চিম পাকিস্তানের চক্রান্তের মধ্যেই ১৯৬১ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। বাঙালি প্রগতিশীল সমাজের সাংস্কৃতিক এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি চলতে থাকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। একটি জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে রূপ তা এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে প্রখর হয়ে ওঠে। এরপর থেকে প্রতিবছরই (১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের কারণে হয়নি) ছায়ানট বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বর্তমানে ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। এই বর্ষবরণ এখন বাঙালির স্বাধিকার চেতনা, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও জাতীয়তাবাদের স্মারক।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানকে কেবলমাত্র মুসলামানদের ভূ-খ- হিসেবে বিবেচনা করত শাসকশ্রেণি। এ জন্য তারা বাংলা বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখকে ‘হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি’ হিসেবে প্রচার করত। সর্বজনীন পহেলা বৈশাখকে তারা ‘সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় তারা এক সময় পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে বাঙালি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আয়োজন করতে থাকে বৈশাখী অনুষ্ঠানমালা।
তৎকালীন পূর্ববাংলা বা বর্তমানের বাংলাদেশে বৈশাখী উৎসবে হালখাতার সূচনা হয় ঢাকার ইসলামপুরের এক কাপড়ের দোকান থেকে। সেই হালখাতার রেওয়াজ এখনও চালু রয়েছে। যদিও এক সময় হালখাতাকে হিন্দুদের উৎসব হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু এটি এখন সাম্প্রদায়িক দেয়ালের বাধা পেরিয়ে বাঙালি ব্যবসায়ী শ্রেণির কাছে আবহমান এক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নগর জীবনে অবশ্য হালখাতার প্রভাব তেমন একটা নেই। কিন্তু দেশের তৃণমূলের ব্যবসায়ীদের কাছে এ আয়োজনটি ব্যাপক জনপ্রিয়। তারা পুরনো বছরের বকেয়ার হিসাব-নিকাশ মেটাতে বাংলা বছরের প্রথম দিনে হালখাতার আয়োজন করে থাকেন। এদিন গ্রাহকরা তাদের বকেয়া পরিশোধ করেন; কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ব্যবসায়ীরা এ সময় তাদের মিষ্টিমুখ করান। এ যেন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার শাশ্বত মেলবন্ধন।
বাংলাদেশে পুরো নব্বইয়ের দশকজুড়ে ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। এই দশকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ সংযোজন করা হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে তখনকার স্বৈরাচার শাসকগোষ্ঠী বাঙালির সংস্কৃতিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে চায়। কিন্তু সচেতন বাঙালি সেদিন রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯ সালে সমস্ত অশুভ শক্তিকে তাড়িয়ে শুভ শক্তির আগমন প্রার্থনায় বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের করা হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। পরবর্তী সময়ে এর নাম হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। যদিও তখনকার শোভাযাত্রা এতটা বর্ণাঢ্য ছিল না। ওই সময়ের শোভাযাত্রার একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। তৎকালীন স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করায় তার বিপরীতে সব ধর্মের মানুষের জন্য বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তবে ১৯৮৯ সালে ঢাকায় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন হয় ১৯৮৫ সালে যশোর জেলায়। যশোরের চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন ওই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। ওই শোভাযাত্রার যারা উদ্যোক্তা ছিলেন তারাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়তে আসেন তখন তাদের হাতেই সূচনা হয় ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রার। তবে এখন শুধু ঢাকা নয় দেশের বিভিন্ন জেলায় পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়।
বর্তমানে বাঙালির বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রায় ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। সম্প্রতি (২০১৬ খ্রি.) এই মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।’ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণের কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয় সংস্থাটি। আর এ স্বীকৃতি আমাদের জন্য এক বিশাল পাওয়া। বলতে গেলে, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এটি।
এছাড়া বৈশাখ উপলক্ষে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয় আবহমানকাল ধরেই। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোনো কোনো শহরেও নববর্ষ উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। বৈশাখী মেলা মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা হিসেবে পরিচিত। মেলাতে স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাতসামগ্রী, হস্ত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী বিক্রি হয়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার সামগ্রী, বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য- যেমন চিড়া, মুড়ি-মুড়কি, খই, বাতাসাসহ বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে। মেলায় থাকে বিনোদনেরও ব্যবস্থা। বিনোদনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা, গাজির গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি। এর পাশাপাশি পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদিরও আয়োজন দেখা যায় বৈশাখী মেলায়।
বৈশাখী মেলা ছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে বৈসাবি উৎসব। পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে যেভাবে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তাই হলো বৈসাবি উৎসব। বৈসাবি বাংলাদেশের তিন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে। সাধারণত বছরের শেষ দুইদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন পার্বত্য তিন জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বর্ষবরণ বা বৈসাবি পালিত হয়।
কয়েক বছর আগেও বৈশাখ নিয়ে সর্বজনীন উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা না গেলেও সম্প্রতি এটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। কারণ সরকার এই উৎসব ঘিরে বিশেষ ভাতার ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকতা-কর্মচারীদের বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ ভাতা চালু করেছে। ফলে ঈদ ও পূজার মতোই রঙ-বেরঙের নতুন পোশাক পরে, নানান রকম বাহারি খাবারের আয়োজন করে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিচ্ছে।
বিচিত্র জীবনবোধ এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময়তায় বর্ষবরণ আমাদের সর্বজনীন সংস্কৃতি। একই সুর ও সংগীতে, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিতে এবং হৃদ্যতার মেলবন্ধনে বৈশাখ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখ মানেই বাঙালির বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার, উদ্বেলিত প্রাণে সুখের বার্তা। বৈশাখ বরণে বাঙালির প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি বারবার এটাই প্রমাণ করে যে, বাঙালি ধর্মান্ধ নয়, বাঙালির বিশ্বাস নেই সাম্প্রদায়িকতায়, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুচিয়ে এগিয়ে চলাই তাদের ধর্ম। বৈশাখ মানেই একই সুতোয় বাঁধা বাঙালি; যে বাঙালির গভীর জীবনদর্শনই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। আর এ কারণেই নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা থাকে- অশুভ শক্তির পরাজয় হোক, জাগ্রত হোক শুভচিন্তা ও বুদ্ধির; প্রতিটি প্রাণে ছড়িয়ে পড়–ক শান্তির শাশ্বত বারতা।
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে,
যাক নদী পার হয়ে, যাক চলি গ্রাম হতে গ্রামে,
পূর্ণ করি মাঠ।
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ। [বৈশাখ/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
লেখক: সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী