শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চরম হতাশায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা

আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:২৫

শেয়ারবাজারে অব্যাহতভাবে প্রায় প্রতিদিনই সূচকের বড়ো পতন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ হতাশা তাদেরকে আতঙ্কিত করছে এই ভেবে যে, কোথায় গিয়ে ঠেকবে শেয়ারবাজার। বাজারের এমন পরিস্থিতিতে শুধু বিনিয়োগকারীই নয় ডিএসইর (ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ) পরিচালকরাও হতাশ। তাই বিপদগ্রস্ত এ বাজারের অবস্থা কী ভাবে ভালো করা যায় সে বিষয়ে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবেন। এ বিষয়ে ডিএসইর ৯৪১তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে ডিএসইর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল সোমবার জানানো হয়েছে। তবে কবে হবে সে বৈঠক সে বিষয়ে এখনো জানানো হয়নি। অর্থমন্ত্রী যখন সময় দেবেন তখনই বৈঠক হবে এমনটা জানা গেছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গতকাল দেশের দুই শেয়ারবাজার ডিএসই ও সিএসইতে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। একটানা ছয় কর্মদিবস এমন দরপতন হচ্ছে। গতকাল ডিএসই প্রধান সূচক ৬২ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৫৩৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। যা গত ৩৯ মাস বা ৭৯১ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট ডিএসই এক্স সূচকের অবস্থান ছিল ৪ হাজার ৫২৬ পয়েন্টে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিম্নমুখী ধারার কারণেই বিনিয়োগকারীদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গত কয়েকদিন অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের নিম্নগতির খবরও গণমাধ্যমগুলোতে আসছে। দেশের অর্থনীতির সূচকগুলো আগের হারে বাড়ছে না বলে গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মাত্র পাঁচ মাসে বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে গত ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৪২ হাজার ৬০৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পুরো সময়ে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়েছিল ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে সরকারের ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার কমছে না। আর বাড়ছে খেলাপি ঋণ। গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ১২ ভাগই খেলাপি হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এতে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে লেনদেন ভারসাম্য আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার নেতিবাচক হয়ে গেছে। গতবছর ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার নেতিবাচক ছিল।

অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় ৪৫ ভাগ বেশি। তবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম আয় করেছে। এসব নেতিবাচক সূচক দেশের অর্থনীতির ভালো দিক ইঙ্গিত করে না। তাই বিনিয়োগকারীদের অনেকেই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এমন কি অনেকেই তাদের বিও অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নিয়ে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। তারা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে অর্থাত্ আওয়ামী লীগ নতুন করে সরকার গঠন করায় বিনিয়োগকারীরা যে আশার আলো দেখেছিলেন তা হতাশায় রূপ নিয়েছে। কারণ, সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করার পর শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবে, বিনিয়োগকারী লাভবান হবেন এমন চিন্তা করা হচ্ছিল। সে অনুযায়ী নির্বাচনের পর পর অনেকেই নতুন করে বিনিয়োগও করেছিলেন। তাতে চলতি বছরের প্রথম দিকে বাজারে কিছুটা চাঙ্গা ভাব দেখা যায়। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, বাজার এখন যে অবস্থায় চলছে তা হতাশাজনক। বিনিয়োগকারীদের পুঁজি আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসের জায়গা কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে নতুন ও ভালো শেয়ারবাজারে আনার বিকল্প নেই।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমানে শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক গত ৩৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। অন্য সূচকগুলোও কমেছে। এর মধ্যে ডিএসইএস বা শরীয়াহ সূচক ১৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ২২ পয়েন্টে এবং ডিএস ৩০ সূচক ২১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৬১ পয়েন্টে।

ডিএসইতে গতকাল টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ২৭৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার। যা গত কার্যদিবস থেকে ৭৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা কম। অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৬৬ পয়েন্ট কমে ১৩ হাজার ৮১৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। সিএসইতে টাকার অঙ্কে ১২ কোটি ৬৮ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে যে লেনদেন হচ্ছে তা দিয়ে ব্রোকারেজ হাউজগুলোই টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। অনেক ব্রোকারেজ হাউজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেক ব্রোকারেজ হাউজ আবার বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছে।

ইত্তেফাক/আরকেজি