২০১৯ সালটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মন্দার বার্তা নিয়ে আসলেও বাংলাদেশের জন্য ছিল ব্যতিক্রম। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্ব জুড়েই। বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃৃদ্ধি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা তাদের উদ্বেগ জানালেও বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদের কথাই বলেছেন। শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাসহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রশংসাও করেছেন তারা। নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও আসছে নতুন বছরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনের দিকে এগুবে এমনটিই প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
অক্টোবরে বিশ্ব ব্যাংকের হালনাগাদ উন্নয়ন প্রতিবেদনে বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বিশ্ব মন্দার ঝাপটা নিয়ে সতর্কও করেছেন। অর্থনীতির সূচকগুলো ২০১৯ সালের শেষ দিকে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেও এ বছর আশা জাগানিয়া সংবাদ হচ্ছে দেশের ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস-২০২০ সূচকে বাংলাদেশ এ বছর আট ধাপ এগিয়ে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম অবস্থানে উঠে এসেছে। অবশ্য এর সুফল এরই মধ্যে পড়তে শুরু করছে। বিদেশি বিনিয়োগে মন্দা কাটাতে বিশেষ উদ্যোগের ফল মিলছে। চলতি অর্থবছরে জুলাই-আগস্টে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৭৫ কোটি মার্কিন ডলারের। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেশি।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক দেশই এখন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্ব জুড়েই। এর বিরূপ প্রভাবে সারা বিশ্বেই বাণিজ্যের গতি কমে গেছে। এরকম প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেরও অভ্যন্তরীণ উত্পাদন ও বিনিয়োগে জোর দিতে বলছেন বিশ্লেষকরা।
এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশেই চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। তবে এর সুফল কিছুটা হলেও বাংলাদেশ পাচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার, যা এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পণ্য রপ্তানি আয়। সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানির গতি কিছুটা কমে আসলেও সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন নতুন বছরে এর গতি ফিলে আসবে। উচ্চ মাত্রায় শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন ক্রেতারা চীনের বিকল্প উত্স থেকে আমদানি বাড়াচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশক শিল্প রপ্তানি বাড়ানোর বড়ো সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
অন্যদিকে, রেমিট্যান্স আয় ইতিবাচক হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ছিল শক্তিশালী অবস্থানে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে যা আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রতি মাসেই রেমিট্যান্স পাঠানোর রেকর্ড গড়ছে। মূলত ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে এর সুফল মিলেছে। বিদায়ি ২০১৯ সালে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সবাই।
বছর জুড়ে ব্যাংকে তারল্য সংকট ছিল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের কাছে ঋণগ্রহীতা হিসাবে আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন না। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যাংক ঋণ আমানতের অনুপাত ধরে রাখতে পারেনি।
গতবারের মতো এ বছরেও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বজায় ছিল। এ বছরের জুলাই-অক্টোবর সময়কালে সার্বিক লেনদেনের ঘাটতি ছিল ২২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাজস্ব আহরণও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম হওয়ায় অর্থনীতির চলমান গতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলেও সমালোচনা ছিল।
গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ বলেছে, ঋণখেলাপি সংকটের কোনো আশু সম্ভাবনাও দেখা যায়নি। অপরদিকে মূলধন সংকটের ফলে বিনিয়োগে নিম্নমুখিতা লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ব্যবস্থার কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি, বরং ঘনীভূত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। স্বাধীনতা লাভ করার পর মাত্র কয়েক কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল যে ছোটো অর্থনীতির দেশটি, সেই দেশের বাজেট আজ ৫ লাখ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যে কোনো সূচকের বিচারে গত দুই দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে প্রশংসনীয়। জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে। জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশ। ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ৩৩তম। বাজেট বাস্তবায়নে পরনির্ভরতাও কমছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে দৃশ্যমান। বড়ো বড়ো প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সক্ষমতাও বাড়ছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজেদের টাকায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। আকাশে উড়িয়েছে নিজস্ব স্যাটেলাইট। তবে প্রত্যাশা এখানেই শেষ নয়। তাই নতুন বছরেও প্রত্যাশা আরো বাড়বে।
ইত্তেফাক/আরকেজি