শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভবিষ্যতৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় উৎপাদক-ক্রেতা বিক্রেতা

আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২০, ০৩:২৫

বদলে গেছে দৃশ্যপট। গুলিস্তান, মতিঝিল, কাওরান বাজার, ফার্মগেট কিংবা ঢাকার অন্যান্য পয়েন্ট—কোথাও সেই চিরচেনা দৃশ্য চোখে পড়ছে না। তবু দুই-এক জন ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, কেউ মাস্ক নিয়ে, কেউ-বা ওয়ানটাইম হ্যান্ড গ্লাভস নিয়ে। যদি দুই-এক জন ক্রেতা পাওয়া যায়। 

একই চিত্র ঢাকার মুদি, কাঁচাবাজারেও। জিনিসপত্রের দামে কিছুটা কমতি। ক্রেতা নেই। বিক্রেতারাও নিরাপদ দূরত্বে। অনেকে জীবন রক্ষার্থে দোকান বন্ধ করে বাসায় স্বেচ্ছাবন্দি। বেসরকারি খাত সাধারণ ছুটির আওতায়। সংবাদপত্র কিংবা জরুরি সেবায় জড়িত লোকেরা শুধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। 

সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা সবার যখন কাজকর্ম বন্ধ, এ অবস্থা কত দিন চলবে এখনই বলা যাচ্ছে না। সেই অনিশ্চয়তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা। 

কাজ ছাড়া কতদিন—উদ্যোক্তার মনে প্রশ্ন। কারখানা না চললে আয় নেই। কর্মীদের বেতনও নেই। বেসরকারি চাকরিজীবীর শঙ্কা—এভাবে চলতে থাকলে কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে ভবিষ্যত্ কী হবে? আর যারা আত্মকর্মসংস্থানে আছেন, সামান্য ঋণ নিয়ে ছোটোখাটো কিছু করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই চলছিলেন, তাদের কী হবে? সবাই শঙ্কায়।

উদ্যোক্তাদের অনেকেই বলেছেন, ব্যবসা ঠিক না থাকলে কর্মীদের বেতনভাতা দেওয়া সম্ভব হবে না। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। বাংলাদেশেও তেমনটি যদি হয়। সরকারের নেওয়া উদ্যোগে অনেক শিল্পমালিক অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, সবাই তো রপ্তানি করে না। তাহলে বাকিরা কি কোনো সুবিধাই পাবে না? তাহলে টিকে থাকবে কীভাবে? 

যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেছেন, শিল্পকারখানা দিয়েছেন, তাদেরও সুবিধা নেই। শুধু জুন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি না দিলে খেলাপি হবে না তারা। কিন্তু জুন পর্যন্ত তাদের বাড়তি সুদ ঠিকই গুনতে হবে। বরং যে প্রেক্ষাপট দেখা যাচ্ছে তাতে কিস্তি পরিশোধও সম্ভবপর হবে না। যা ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বাড়াবে। 

বিদ্যমান অবস্থায় আরো বেশি সংকটময় পরিস্থিতির আশঙ্কার কথা বলেছেন উদ্যোক্তারা। আর তা যদি বাস্তবে ঘটে, তাহলে বাংলাদেশেও চাকরিচ্যুতির বিকল্প থাকবে না। বাড়ন্ত বেসরকারি খাত যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে বেকারত্বের বোঝা বইবার মতো শক্তি কি বাংলাদেশের আছে—সে প্রশ্নও করেছেন অনেকে।

আর্থিক খাতের সূত্রগুলো বলেছে, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে চরম আর্থিক ও মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে। তখন হাতে নগদ টাকার সংকট বাড়বে এবং সংকট অব্যাহত থাকলে মানুষের ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষমতাও দিন দিন হ্রাস পাবে। আর তাতে উত্পাদক থেকে সাধারণ বিক্রেতা এবং ক্রেতা—সব পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

ব্যবসায়ীরাও বলেছেন, করোনা নিয়ে যেসব সতর্ক বার্তা আসছে তাতে কোনো ধরনের খামখেয়ালিপনার সুযোগ নেই। আর্থিক সক্ষমতা না থাকলে পণ্যের মজুত দিয়েও কোনো লাভ হবে না, যদি সাধারণ মানুষ ভোগ্যপণ্য কিনতে না পারে।

তবে সরকারঘোষিত তহবিলের সুবিধা দাবি করেছেন অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তারাও। তাদের মতে, করোনার আঘাত সবখাতেই পড়েছে। সবখাতেই চাকরি হারানোর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই মানুষের হাতে নগদ টাকা সরবরাহ বাড়াতে না পারলে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। 

ইতিমধ্যে বাজারে পণ্যসামগ্রীর যথেষ্ট মজুত রয়েছে। কিন্তু বাজার ক্রেতাশূন্য। ঘরে বসে থাকলে, আয় না থাকলে, চাকরি চলে গেলে কিনতে না পারলে এক সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যা আগেভাগেই প্রস্তুতি না নিলে পরে সামাল দেয়া দুঃসাধ্য হবে।

এদিকে, রেমিট্যান্সনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে— করোনার কারণে প্রচুর বাংলাদেশি দেশে ফেরত এসেছে। ওসব দেশও করোনা আক্রান্ত হওয়ায় বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বড়ো ধাক্কা খাবে। যা রেমিট্যান্সনির্ভর পরিবারগুলোর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াবে। কমে যাবে ওসব পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা। একইভাবে কমে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য। গ্যাস বিল মওকুফ করা হয়েছে সেখানে। নিয়মিত সুবিধার অতিরিক্ত বিনা মূল্যে চাল, ডাল দেওয়া হচ্ছে। বিমা সুবিধাসহ আর্থিক সুবিধার আওতায় থাকবে ৮০ কোটি মানুষ। বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের ‘কম্প্রেহিনসিভ’ কোনো পদক্ষেপ নেই।

ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তৌফিক এহসান জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা চরম দুরবস্থায় ভুগছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, ব্যাংক লোন, বিদ্যুত্ ও সার্ভিস চার্জ বিলসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিল মওকুফ চেয়ে সমিতির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

প্রচ্ছন্ন রফতানি খাতগুলোও সরকারঘোষিত সুবিধা প্রাপ্তির দাবি রাখে। কিন্তু সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল কাদের খান জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আর্থিক সুবিধা না পেলে ব্যবসায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সব খাতকেই সুবিধা দিতে হবে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেন এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারে এবং বিরূপ পরিস্থিতি এড়াতে নগদ আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে হবে। যেমনটি অন্যান্য দেশ করেছে। তারা বাসায় পাঠিয়ে ক্ষান্ত হননি, চাকরিজীবীদের বাসায় নগদ অর্থও পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।

ইত্তেফাক/জেডএইচ